রাজু আহমেদ। কলামিস্ট।|
তাবৎ পড়াশুনার আধেক শুদ্ধাচার। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রায়োগিক ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতা না থাকলে কালির হরফের শুদ্ধাচার দিয়ে মানুষের স্বভাব বদলানো যাবে না। মানুষ না বদলালে সমাজ বদলাবে না। বইয়ের পৃষ্ঠায় যে শুদ্ধাচার, বক্তৃতা-স্লোগানে যে শুদ্ধাচার সেটা পরিবারে এবং প্রতিষ্ঠানে কতোটুকু আছে কিংবা কতোখানি অনুপস্থিত-সে বিষয়ে গবেষণা দরকার। বৃটিশ আমলের বিল্ডিং এখনো দাঁড়িয়ে আছে অথচ সেদিন নির্মাণ করা রাস্তা-সেতু-ইমারত অল্পদিনেই যখন ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়েছে তখন সেটা স্বচক্ষে দেখে শুদ্ধাচারের আমলে প্রভাবিত হওয়া মুশকিল। বাবার বেতনের টাকার চেয়ে উপরি কামাই বহুগুন বেশি দেখতে দেখতে বড় হওয়া সন্তানের কাছে শুদ্ধাচারের পাঠ সিনেমার ডায়লগের মত রাবিশ-বোগাস! একটা সময় বইয়ে-কথায় শুদ্ধাচারের পাঠ ছিল না অথচ সর্বত্র শুদ্ধাচার ছিল। এখন সর্বত্র শুদ্ধাচারের তত্ত্বকথা অথচ ব্যবহারিক জীবনে তা প্রবলভাবে অনুপস্থিত।
'সেবাদাতা জনগণের বন্ধু' পড়তে পড়তে মুখে ফেনা তোলা ছেলেটি সেবা নিতে গিয়ে যখন দ্বারে দ্বারে উপায়হীন হয়ে ঘোরে, আবার বিশেষ জায়গায় কিছু অর্থ ছাড়লে সেবা সহজীকরণ হয়, এমন চিত্র যারা দেখেছে, অভিজ্ঞতা হয়েছে তাদের কাছে শুদ্ধাচারের বুলি সোফিস্টদের মত অর্থ কামাইয়ের আরেকটি রাস্তা মনে হয়! শিক্ষক শিক্ষার্থীদেরকে প্রাইভেটে বাধ্য করছে, মেম্বার-চেয়ারম্যান অর্ধেক সেবা দল-বল নিয়ে ভোগ-দখল করছে, ব্যাংকের টাকা সমানে লোপাট হচ্ছে, ডাক্তার হাসপাতালের রোগী এবং চেম্বারের রোগীকে সমানভাবে দেখছে না, আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে-এগুলোতে অভ্যস্ত হওয়া, হয়রানি হওয়া মানুষগুলোর কাছে শুদ্ধাচারের আবেদন কতোখানি? মাঝে মাঝে মনে হয়, শুদ্ধাচারের সাইনবোর্ড টানিয়ে আড়ালে-আবডালে সুবিধাবাদী শ্রেণি তাদের সিন্ধুক ভরে নিচ্ছে।
গ্রামের আদর্শবাদী কথা বলা ছেলেটি, নৈতিকতা সম্পর্কে দরস দেয়া লোকটি চাকুরি পেয়েই চোদ্দগুষ্টির ভাগ্য বদলে ফেলছে। বাজার দরের সাথে তালমিলিয়ে বেতনের অর্থে সমান সমান থাকাই মুশকিল অথচ ফ্লাট-বাড়ি, ব্যাংক-ব্যালেন্সে কাড়ি কাড়ি অর্থের যোগান অল্পদিনে হচ্ছে। মসজিদ-মাহফিলে বেশি বেশি দান দেখে মানুষ বাহবা দিচ্ছে আবার ভোগের সরঞ্জাম দেখে টিপ্পনীও কাটছে! শুদ্ধাচারের পাঠ কামাইয়ের মাঠে খুব বেশি কাজ করছে না। তবে সাদা চোখে এটা স্পষ্ট, দুর্নীতিবাজ-অসাধুদের সাথে না পেরেই রাষ্ট্র বেশি বেশি শুদ্ধাচার আমদানি করছে। বিদেশিরাও শুদ্ধাচার বিক্রি করতে পেরে বেশ লাভবান হচ্ছে। অথচ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, প্রকাশ্যে শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে বাপ-বাপ বলে কত মানুষ যে সোজা পথে হাঁটতে বাধ্য হতো। কাগজের কুমির দিয়ে ভয় দেখানো যায় কিন্তু যাদেরকে ভয় দেখানো হয় তারা আদৌ ভয় পায় কিনা কে জানে!
রাজনীতিতে পয়সা আছে, ব্যবসায়ীরা বাজারের রাজা এবং অন্যান্য অনেক জায়গায় আয় ভালো। সমাজ এগুলো যখন আঙুল দিয়ে দেখায় তখন শুদ্ধাচার ঝিমিয়ে পড়ে। ক্লাস-সিম্পোজিয়ামে চর্চা সর্বত্র হয় কিন্তু প্রয়োগ ক্ষেত্র সংকীর্ণ। ভালো মানুষ, নীতিবান মানুষ, শুদ্ধাচারি মানুষের সংখ্যা কম সেটা বলার কোন সুযোগ নাই। প্রত্যেক জায়গায় অনেক অনেক ভালো লোক আছে। তবে তারা আলোতে নাই, সামনের সারিতেও নাই। সমাজের বহিরাঙ্গন থেকে যাদের বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে তাদের নামে ধন্য ধন্য করা হয়। বিপুল অর্থ কীভাবে, কোন পথে এলো? সমান মর্যাদার, একই বেতনে একজন আধা-বস্তির শেষ মাথায় পরিবার নিয়ে ভাড়ায় থাকে, আরেকজনের অস্ট্রেলিয়া-কানাডায় বাড়ি-নারী আছে! একজন পেটপুরে খেতে পারে না আরেকজন রাজ্যের খাবার নষ্ট কর। সমাজস্থরা শুদ্ধাচারকে বুড়ো আঙুল প্রদর্শন করে এবং যার ধন মোটা তাকে নমঃ নমঃ করে।
বর্তমান সময়ে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম অন্ধ নর! কালো কাপড় দিয়ে তাদের চোখ বেঁধে রাখা যাবে না।পরীক্ষায় পাশ করার জন্য শুদ্ধাচার পড়তে বাধ্য হলেও এদের শেখার মূলক্ষেত্র পরিবার এবং সমাজ। চাকুরি পেয়েই, সুযোগ পেয়েই কোথায়-কীভাবে দুপয়সা বাড়তি কামাই করার সুযোগ মেলে সে গর্ত খুঁজতে থাকে। তারন পাশের ডেস্কে, চলার পথে আদর্শ পেয়ে যায়। অতপর পাঙ্গাশের মত খাদ্য-অখাদ্য সব গ্রাস করতে শুরু করে। শুদ্ধস্বরে বলে দেয়, শুদ্ধাচার মানলে জীবনে শাক-কচুতেই কাটাতে হবে! অথচ নরম বিছানা, মাছ-মাংস আর বিলাসিতা চাই। তাকে দেখে আরেকজন উদ্ভুদ্ধ হয়। একদিকে শুদ্ধাচারের নীতিমালা প্রিন্ট করার মেশিন বাড়ে, কাগজ খরচ বাড়ে। অন্যদিকে কারো কারো ভূরি বাড়ে, বাড়ি বাড়ে। প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য বউ বাড়ে! মোরে ক্ষমা করো পাঙ্গাশ, তোমরা আমাদের অর্ধ পুষ্টি নিশ্চিত করো।
জোড়ালোভাবে আইনের শাসন জরুরি। কোন ফাঁক-ফোকর থাকবে না। অবৈধভাবে দু'পয়সা গ্রহন করলেই লোভের জিহ্বায় দাগ দিতে হবে। শুদ্ধাচারের পাঠ অবশ্যই জরুরি তবে ব্যবহারিক জীবনেও শুদ্ধতা থাকতে হবে। চোখে দেখবো একরূপ আর বিশ্বাস করতে হবে আরেক রূপ এমন দ্বিচারিতা মন মেনে নিতে চায় না। বোধহয় পারেও না। লোহা পুড়িয়েই তার ছাঁচ বদল করতে হয়। নবীরা ফু দিয়ে পরিবর্তন করতে পারতেন কিন্তু এই যুগে হ্যামার লাগবে। হ্যামারের ব্যবহার রাষ্ট্রের হাতেই রাখতে হবে। এই দেশটা সুন্দরভাবে চালাতে, প্রাচুর্যে-সৌন্দর্যে গড়তে এতো মানুষের দরকার নাই। কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মহীন হোক, কিছু গাদ্দার সমাজ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হোক। তবেই অনেককিছু আপনা আপনি সোজা হয়ে যাবে।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন