হুসনা খান হাসি ||
প্রতিটি পরিবার এক একটি ভিন্ন গল্পের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠে। গৃহের দেয়াল যত সুন্দর হোক, সেই গৃহের মানুষদের মনেই লুকিয়ে থাকে আনন্দ ও কষ্টের নানা রঙ। কখনও দেখা যায় বাবা-মায়ের স্নেহের উষ্ণতা সবার জন্য সমান থাকে না। ছেলে ও মেয়ের প্রতি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলা এক অদ্ভুত বৈষম্য তৈরি করে যা পরিবারের নীরব শান্তিকে ধীরে ধীরে ভেঙে দেয়।
ছোটবেলা থেকেই অনেক মেয়ে অনুভব করে যে তাদের কাজকর্ম, কথা বলা, এমনকি হাসি পর্যন্ত আলাদা করে বিচার করা হয়। ভাই যদি দেরি করে বাড়ি ফেরে তা সহজে ক্ষমা হয়, কিন্তু বোনের ক্ষেত্রে শুরু হয় নানা প্রশ্ন আর তিরস্কার। এই অদৃশ্য নিয়মের ভিতর দিয়ে গড়ে ওঠে এক ধরনের অসন্তোষ যা কখনো প্রকাশ পায় না কিন্তু মনে গভীর ছাপ ফেলে।
বাবা-মা প্রায়ই মনে করেন তারা কেবল মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত, কিন্তু এই বাড়তি নিয়ন্ত্রণ আসলে বিশ্বাসের ঘাটতি প্রকাশ করে। অন্যদিকে ছেলেদের স্বাধীনতায় তারা এক ধরনের গর্ব অনুভব করেন। এই ভিন্নতা মেয়ে শিশুকে মনে করিয়ে দেয় যে তার স্বপ্ন ও স্বাধীনতা কম গুরুত্বপূর্ণ। সময়ের সঙ্গে এই অনুভূতি তাকে ধীরে ধীরে নিঃশব্দে বিদ্রোহী করে তোলে।
বৈষম্যমূলক স্নেহের আরেকটি দিক হলো শিক্ষার ক্ষেত্রে পার্থক্য। অনেক সময় মেয়ের পড়াশোনা নিয়ে পরিবারের আশা সীমিত থাকে। বাবা-মা মনে করেন মেয়ে বড় হয়ে সংসার সামলাবে, তাই উচ্চশিক্ষা বা পেশার প্রতি তেমন গুরুত্ব নেই। বিপরীতে ছেলে সন্তানের জন্য তারা বড় স্বপ্ন দেখেন। এই অবস্থায় মেয়ের মনের ভেতর জন্ম নেয় এক ধরনের অপূর্ণতা ও ক্ষোভ যা তার আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয়।
পারিবারিক কাজের বণ্টনেও দেখা যায় এই বৈষম্য। ঘরের দায়িত্ব প্রায়শই মেয়ের কাঁধে চাপানো হয়। রান্না, পরিষ্কার, অতিথি আপ্যায়ন, সব যেন তার কর্তব্য। ভাই হয়তো অবসরে খেলছে, তবু তার জন্য প্রশ্ন নেই। এই নীরব নিয়ম মেয়ের মনে বারবার মনে করিয়ে দেয় যে তার শ্রমকে স্বাভাবিক মনে করা হচ্ছে, অথচ তার নিজের চাওয়া-পাওয়া উপেক্ষিত।
মানসিকভাবে এই অসম আচরণ ছেলের ওপরও প্রভাব ফেলে। সে শিখে নেয় যে নারীর কাজ ভিন্ন, নারীর ইচ্ছার গুরুত্ব কম। ফলে পরবর্তী জীবনে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সে অবচেতনভাবে আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। বাবা-মায়ের অজান্তেই তারা ছেলে শিশুর মধ্যে এক ধরনের অহংবোধ তৈরি করে যা সমাজে বৈষম্যকে টিকিয়ে রাখে।
কখনও কখনও বাবা-মা মনে করেন যে এই পার্থক্য ভালোবাসার অভাব নয়, বরং সুরক্ষা। কিন্তু আসলেই এটি ভালোবাসার বিকৃত রূপ। সুরক্ষা যদি হয়, তবে সেটি সমানভাবে হওয়া উচিত। মেয়ে সন্তানকে সবসময় ভয় দেখিয়ে আটকে রাখা তাকে নিরাপদ করে না, বরং তাকে পৃথিবীর সামনে দুর্বল করে তোলে।
এই বৈষম্য কাটানোর জন্য প্রথমে দরকার সচেতনতা। বাবা-মাকে বোঝা উচিত যে ছেলে ও মেয়ে সমান সম্ভাবনা নিয়ে জন্ম নেয়। ঘরের নিয়ম ও সিদ্ধান্তে সবার মতামত সমানভাবে গ্রহণ করা উচিত। দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট আচরণ পরিবর্তনের মাধ্যমে বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব।
পারিবারিক আলোচনা এখানে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বললে ভুল ধারণা ভাঙতে সময় লাগে না। ছেলে সন্তানকেও শেখাতে হবে যে দায়িত্ব, যত্ন ও স্বাধীনতা দুজনের জন্য সমান। এই শিক্ষা শুধু পরিবারকেই নয়, পুরো সমাজকেই ন্যায়ের পথে এগিয়ে নিতে পারে।
পরিবারে সমতা প্রতিষ্ঠা কেবল মেয়ের অধিকার নয়, ছেলেরও বিকাশের জন্য জরুরি। সমান স্নেহ ও সমান স্বাধীনতা পেলে সন্তানরা নিজেদের স্বপ্ন গড়ে তুলতে পারে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সম্পর্কের মূল্য বুঝতে পারে।
শেষ পর্যন্ত, একই গৃহের অসম স্নেহ একটি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ। বাবা-মা যদি সচেতন হন, তবে ঘরের ভেতর থেকে এই বৈষম্য মুছে ফেলা সম্ভব। সমান ভালোবাসা ও সমান সুযোগ সন্তানদের শুধু সুস্থ করে তোলে না, পুরো সমাজকেও করে তোলে আরও ন্যায়বান ও মানবিক।
সংক্ষেপে বলা যায়, একই গৃহে ছেলে-মেয়ের প্রতি অসম স্নেহ শুধুই ব্যক্তিগত কষ্টের কারণ নয়, এটি সামাজিক ও মানসিক বিকাশেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। বাবা-মা যদি সমান ভালোবাসা, সমান সুযোগ এবং সমান স্বাধীনতা দেন, তাহলে সন্তানরা আত্মবিশ্বাসী, সচেতন এবং দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। বৈষম্য মুছে ফেলার প্রচেষ্টা কেবল পরিবারের সম্পর্ককে মজবুত করবে না, বরং সমাজকে আরও ন্যায়পরায়ণ ও মানবিক করে তুলবে। সমতার ভিতেই নিহিত সুখ, সুরক্ষা এবং বিকাশের বাস্তব অর্থ।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন