ডেটিং সাইট এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে রোমান্স স্ক্যামাররা: ডিজিটাল যুগে একটি বাড়তে থাকা হুমকি

gbn

হুসনা খান হাসি॥

আজকের ডিজিটাল যুগে, যেখানে অনলাইনে সম্পর্ক তৈরি ও যোগাযোগ স্বাভাবিক বিষয় হয়ে উঠেছে, অনেকেই প্রেম, বন্ধুত্ব এবং সঙ্গী খুঁজে পাওয়ার জন্য ডেটিং সাইট ও সোশ্যাল মিডিয়ার উপর নির্ভরশীল। সেখানে রোমান্স স্ক্যাম একটি গুরুতর ও বেড়ে চলা হুমকিতে পরিণত হয়েছে। ডেটিং অ্যাপ ও সোশ্যাল মিডিয়া যেমন মানুষকে কাছাকাছি আনছে, তেমনি কিছু প্রতারক মানুষের আবেগিক দুর্বলতাকে পুঁজি করে চালিয়ে যাচ্ছে আর্থিক ও মানসিক প্রতারণা।

রোমান্স স্ক্যাম হলো এমন এক প্রতারণা যেখানে স্ক্যামাররা প্রেমের সম্পর্কের ভান করে কাউকে অর্থ বা ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে প্রতারিত করে। এই স্ক্যামাররা নিজেদেরকে সহানুভূতিশীল ও বিশ্বস্ত প্রেমিক বা প্রেমিকা হিসেবে উপস্থাপন করে। তারা কথাবার্তায় ভালোবাসা, ভবিষ্যতের স্বপ্ন, ও বিশ্বাসের আবরণে একটি সম্পর্ক গড়ে তোলে। একসময় সেই সম্পর্ক “লাভ বম্বিং”-এ রূপ নেয়—যেখানে একের পর এক প্রেমের বার্তা দিয়ে আবেগিকভাবে কাউকে জড়িয়ে ফেলা হয়। এরপরই শুরু হয় আসল খেলা: অসুস্থতা, দুর্ঘটনা বা জরুরি ভ্রমণের অজুহাতে অর্থের অনুরোধ। প্রতিশ্রুতি থাকে—টাকা ফেরত দেওয়া হবে বা দেখা হবে। কিন্তু সেই দিন আর আসে না।

কারা বেশি ঝুঁকিতে?? স্ক্যামারদের টার্গেট হওয়ার প্রধান কারণ ‘আবেগিক দুর্বলতা’। তবে নিচের কিছু গোষ্ঠী বিশেষভাবে ঝুঁকিতে: বয়স্ক এবং প্রযুক্তিতে অনভিজ্ঞ ব্যক্তি তালাকপ্রাপ্ত বা সদ্য বিধবা দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতা বা প্রতিবন্ধকতায় ভোগা মানুষ যাদের লোকাল ডেটিং অপশন সীমিত

অনেকেই ধারণা করেন, স্ক্যামের শিকাররা অজ্ঞ বা সরল। বাস্তবতা হলো, তারা অনেক সময় শিক্ষিত, সচেতন ও সফল মানুষ, তাদের একমাত্র দুর্বলতা ছিল ভালোবাসা ও বিশ্বাস।

বাংলাদেশেও এই প্রবণতা ধীরে ধীরে বেড়ে চলছে। অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়াতে বিদেশি প্রেমিক/প্রেমিকার প্রলোভনে পড়ে বড় অঙ্কের টাকা হারাচ্ছেন। মিডিয়ায় প্রায়ই এমন ঘটনার খবর আসে যেখানে ভুয়া প্রেমিকের ফাঁদে পড়ে কেউ সবকিছু হারিয়েছেন।

রোমান্স স্ক্যামের আর্থিক ক্ষতি বিশাল। শুধু ২০২৩ সালেই যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষতির পরিমাণ ১.৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। তবে অর্থের চেয়েও ভয়ংকর এর মানসিক প্রভাব। আত্মসম্মান হারানো, বিষণ্ণতা, এবং ভবিষ্যতে সম্পর্কের প্রতি ভয়, সবই এই প্রতারণার পরিণতি।

এই স্ক্যামগুলো শুধু আর্থিক ক্ষতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, মানসিক এবং সামাজিক ক্ষতিও তৈরি করে। প্রতারিত ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস কমে যায়, সম্পর্কের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং অনেক সময় মানসিক অবসাদেও ভোগে।

স্ক্যামারদের চিহ্নিত করা সহজ নয়, কারণ তারা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তাদের পরিচয় গোপন রাখে এবং আবেগপ্রবণ কথাবার্তা বলে ভিকটিমকে প্রভাবিত করে। তারা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং যতটা সম্ভব বিশ্বাসযোগ্য চরিত্রে অভিনয় করে।

কীভাবে নিজেকে রক্ষা করবেন? এই সমস্যা মোকাবেলায় সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। ব্যবহারকারীদের জানা দরকার কীভাবে এই ধরনের প্রতারণা চিহ্নিত করতে হয়। যেমন: খুব তাড়াতাড়ি প্রেমের প্রস্তাব, বারবার আর্থিক অনুরোধ করা ইত্যাদি স্ক্যামের লক্ষণ। খুব তাড়াতাড়ি ভালোবাসার কথা বললে সতর্ক হোন বারবার অর্থ চাইলেই লাল সংকেত প্ল্যাটফর্ম বদল করতে চাইলে সন্দেহ করুন ব্যাকস্টোরি মিলিয়ে দেখুন, আর রিভার্স ইমেজ সার্চ ব্যবহার করুন কোনো সন্দেহ হলে পরিবারের সাথে শেয়ার করুন। একাকীত্বের সুযোগেই স্ক্যামাররা ঢুকে পড়ে—তাই সচেতনতাই প্রথম সুরক্ষা।

রোমান্স স্ক্যাম প্রতিরোধে আমাদের সম্মিলিত ভূমিকা দরকার। ব্যবহারকারীদের সচেতনতা যেমন জরুরি, তেমনি প্ল্যাটফর্মগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে। ডেটিং সাইট ও সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোকে ভুয়া প্রোফাইল শনাক্তে আরও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে, এবং ব্যবহারকারীদের রিপোর্টিং ব্যবস্থাকে সহজ করতে হবে। প্রশাসনিক স্তরেও আইন প্রয়োগ, তদন্ত ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন।

সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও এই বিষয়ে আরও সক্রিয় হতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাইবার ক্রাইম ইউনিট এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় এই স্ক্যামারদের আইনের আওতায় আনা জরুরি।

ডেটিং সাইট এবং সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে। তাদের উচিত ব্যবহারকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, সন্দেহজনক অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া এবং ভেরিফিকেশন পদ্ধতি আরও কঠোর করা।

ব্যক্তিগতভাবে আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজের তথ্য সুরক্ষিত রাখা এবং অপরিচিত কারো সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা। আবেগের জায়গা থেকে নয়, যুক্তির জায়গা থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।

পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবদের ভূমিকাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। যদি কেউ এমন সম্পর্কের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে তার প্রিয়জনদের উচিত সহানুভূতিশীলভাবে তার সঙ্গে কথা বলা এবং তাকে সঠিক পথে পরিচালনা করা।

শেষ পর্যন্ত, রোমান্স স্ক্যাম হলো আধুনিক প্রযুক্তির একটি অন্ধকার দিক, যা শুধু ব্যক্তি নয়, সমাজকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সচেতনতা, প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা, আইনগত পদক্ষেপ এবং পারিবারিক সহযোগিতাই পারে এই হুমকি মোকাবেলা করতে। আমরা সবাই মিলে এই ডিজিটাল বিপদ থেকে নিজেদের ও অন্যদের সুরক্ষিত রাখতে পারি।

সব শেষে, রোমান্স স্ক্যাম হচ্ছে প্রযুক্তি, আবেগ ও অপরাধের একটি মারাত্মক মিশ্রণ। অনলাইন প্রেম যেমন সম্ভাবনার দরজা খোলে, তেমনি তা ভয়ানক বিপদেরও রাস্তাও তৈরি করে। এই প্রতারণা ঠেকাতে হলে আমাদের আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণ, প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান এবং সচেতনতা—এই তিনটিই অত্যন্ত জরুরী।

প্রতিটি স্ক্যামের পেছনে লুকিয়ে থাকা একজন প্রতারক, আর প্রতিটি ভুক্তভোগী একজন বাস্তব মানুষ। তাই এটি শুধু প্রযুক্তিগত লড়াই নয়—এটি সচেতনতার, সহানুভূতির এবং মানবিকতার লড়াই।

রোমান্স স্ক্যাম বা অনলাইন প্রতারণার শিকার হলে দ্রুত অভিযোগ জানানোই সবচেয়ে জরুরি পদক্ষেপ। এই ধরনের প্রতারণা রোধে ভুক্তভোগীরা সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন অথবা ওয়েবসাইটে গিয়ে অনলাইনে অভিযোগ জমা দেওয়ার সুবিধাও রয়েছে। ফেসবুক বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে স্ক্যামারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রতিটি প্ল্যাটফর্মের নিজস্ব “Report” অপশন ব্যবহার করা যায়। পাশাপাশি, ডেটিং সাইটগুলোর হেল্প ডেস্কে অভিযোগ জানালে সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টটি সাময়িকভাবে সাসপেন্ড বা স্থায়ীভাবে ব্লক করা হতে পারে। সঠিক তথ্য ও প্রমাণসহ অভিযোগ করলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুত পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়।

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন