নজরুল ছিলেন কেবল কবি নন, ছিলেন এক ঐতিহাসিক সত্তা
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।
‘কাঠবেড়ালী! কাঠবেড়ালী! পেয়ারা তুমি খাও?’ কিংবা ‘ভোর হল/দোর খোলো/খুকুমনি ওঠরে!’—এসব পংক্তিমালার স্রষ্টার জন্মদিনে তাঁকে কী উপহার দেব? তাঁর কবিতার সাথে আজীবনের প্রেমই হোক আমার শ্রদ্ধার শ্রেষ্ঠ উৎসর্গ।
ছেলেবেলায় ‘প্রভাতী’ ও ‘খুকী ও কাঠবেড়ালী’র মাধ্যমে যেভাবে কাজী নজরুল ইসলামের সাথে পরিচয়, তা যেন পরবর্তী জীবনে ক্রমশ রূপ নেয় এক আত্মিক বন্ধনে। বয়সের সাথে সাথে তাঁর ‘বিদ্রোহী’, ‘সাম্যবাদী’, ‘মানুষ’, কিংবা ‘নারী’র মতো কবিতার মাধ্যমে আমি মিশে গেছি তাঁর শক্তিমান সত্তার সঙ্গে। তাঁর লেখাগুলোর প্রতিটিই যেন একান্ত এক সংলাপ—মনের গভীরে বয়ে যাওয়া নিরব কথোপকথন।
‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাস কিংবা ‘আমরা লক্ষ্মীছাড়ার দল’ প্রবন্ধ পাঠ করতে গিয়ে উপলব্ধি করেছি, বাস্তবতার এমন সাহসী ও জ্যান্ত রূপায়ণ নজরুল ছাড়া আর কেউ করতে পারেননি। তাঁর রচনার গভীরতা, আবেগ, দ্রোহ ও প্রেম—সবকিছু পাঠককে করে তোলে বিস্মিত, শিহরিত।
নজরুল ছিলেন কেবল কবি নন, ছিলেন এক ঐতিহাসিক সত্তা—একজন পথপ্রদর্শক, যিনি আমাদের চিনিয়েছেন মানুষের মর্যাদা, আত্মমর্যাদা ও সাম্যের সৌন্দর্য। দারিদ্র্য তাঁকে থামাতে পারেনি, বরং তিনি সৃষ্টি করেছেন ‘দারিদ্র্য’ ও ‘দরিদ্র মোর পরমাত্মীয়’র মতো অসামান্য কবিতা। তিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বল্পশিক্ষিত হলেও তাঁর লেখনীতে ফুটে উঠেছে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বিরল সম্মিলন।
বৃটিশ সাম্রাজ্যের শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন বজ্রকণ্ঠ। ‘আনন্দময়ীর আগমন’ কবিতা তাঁকে কারাবরণ করালেও থামাতে পারেনি। কারাগার, নিপীড়ন, কিংবা বাকরুদ্ধতা—কিছুই তাঁর চেতনাকে নিঃশেষ করতে পারেনি। বরং তিনি ফিরে এসেছেন নতুন শপথ, নতুন দিগন্তের আলো নিয়ে।
নজরুল গীতির সমৃদ্ধ ভাণ্ডার বাংলা গীতিসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। ‘কে বিদেশী বন-উদাসী’, ‘মুসাফির! মোছ আঁখি-জল’, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’, কিংবা ‘আমার দেশের মাটি’—এইসব গানে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর অন্তর্গত প্রেম, দেশপ্রেম, ও আধ্যাত্মিকতা।
তাঁর ভাষা শুধু বাংলা নয়; ফার্সি, হিন্দি, উর্দু ও আরবির মিলনে তিনি গড়ে তুলেছেন এক অনন্য অলংকারময় ভাষাশৈলী। নজরুলের সাহিত্যে বহুভাষিকতা কেবল পাণ্ডিত্যের নিদর্শন নয়, বরং তা ছিল সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের এক মহান প্রয়াস।
তাঁর সেই যুগান্তকারী ঘোষণা—
‘গাহি সাম্যের গান—মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!’
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম—ওহে জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারী! বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।’
এই পংক্তিমালাগুলো শুধু কবিতা নয়, সময়ের দাবিতে এক একটি বিপ্লবী উচ্চারণ।
আজও নজরুল পাঠকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে দূরে রাখা হচ্ছে। তাঁর সাম্যবাদী ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা হয়তো অনেকের স্বার্থে আঘাত করে, তাই তাঁকে উপেক্ষা করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু সত্যিকারের পাঠক তাঁর কাছেই ফিরবে, বারবার।
তাই জন্মদিনে নয়, প্রতিটি দিনেই নজরুল আমাদের জীবনে, রক্তে, নিঃশ্বাসে।
ভালোবাসি নজরুলকে—ভালোবাসি তাঁর প্রতিভা, তাঁর সাহস, তাঁর মানুষ হয়ে ওঠার নিরন্তর সাধনাকে।
ভালো থেকো, কবি। তোমার পথ ধরে আমরা যেন আলোর পথে চলতে পারি—এই হোক জন্মদিনের প্রার্থনা।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন