আলহাজ্ব নজরুল ইসলাম কয়ছর ||নিউইয়র্ক।|
রাজনীতি ও রাস্ট্র পরিচালনার দায়-দায়িত্ব প্রকৃত রাজনীতিবিদদের হাতছাড়া হয়ে গেলে একটা দেশে যা যা পরিণতি হবার সম্ভাবনা থাকে — বাংলাদেশে এখন তাই হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চেষ্টা করছেন কিন্তু তিনি কার্যত একাই সংগ্রাম করছেন। অন্যরা যে এই অতিমারীর বিপদ মোকাবিলার চেয়ে নিজেদের আখের গোছানোতে ব্যস্ত তা আজ দিনের আলোর মত স্পষ্ট নয় কি? যে কোনো দেশের জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলার পূর্বশর্ত হচ্ছে ত্যাগ, শাসক সংশ্লিষ্টদের দেশপ্রেম ও বাস্তবজ্ঞান সমৃদ্ধ সিদ্ধান্ত। কোভিড-১৯ প্রতিরোধী কার্যক্রম পরিচালনায় এবং দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার বর্তমান পরিস্থিতিতে এর কোনোটি-ই শাসক শ্রেণির চরিত্রে পরিলক্ষিত নয়।
রতি-মহারতিরা বলছেন, কোভিড-১৯ এর বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশে চিকিৎসা সংকট প্রকট হয়েছে। তাঁদের সাথে আমার মতামতের ভিন্নতার কারণ হলো এই যে — আমাদের দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের কর্মপন্থা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ এবং স্বাস্থ্য-জনবল বিষয়ে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির ঘোষণা দীর্ঘদিন থেকে লঙ্ঘিত হয়ে আসছে। এতদিন যে বিষয়টি চাপা পরেছিল, বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে এই বিষয়টি আর চাপা দিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ব্যবস্থাপনার নানা দিক, ত্রুটি-বিচ্ছ্যুতিগুলো এবং ইহার সাথে সম্পৃক্ত দুর্নীতি জনসম্মুখে ভেসে আসছে। ১৯৭৫ পরবর্তী সময় থেকে অদ্যাবধি যারা মন্ত্রী-আমলা নিযুক্ত হয়ে দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করছেন তাঁদের সবাই কোনো না কোনোভাবে বেসরকারি চিকিৎসা সেবা বাণিজ্যের সুবিধাভোগী। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় এবং দেশের সংবিধান মতে, রাষ্ট্রের মালিক জনগণ এবং আমলা-কর্মচারীগণ জনগণের চাকর। মালিক জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি=মন্ত্রী। কিন্তু ক্ষমতার মসনদে আসীন মন্ত্রীরা যে নিজেদের কায়েমী স্বার্থে অধিকাংশ জনগণের প্রতিনিধিত্ব না করে মুষ্টিমেয় তথা গোষ্ঠী-স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করছেন - এটা বলা বাহুল্য। এদের কেউ কেউ অদক্ষ হলেও উপরোক্ত কায়েমী স্বার্থের কারণে বেশির ভাগ-ই স্বেচ্ছায় অপদার্থের ভূমিকা পালন করেন। কোনটা চিকিৎসা সংকট, কোনটা ব্যবস্থাপনা সংকট — এই বিষয়টি এরা বুঝেও না-বুঝবার অভিনয় করেন।
যে কোনো দেশের জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় রাষ্ট্র- কাঠামোর অধীনে থাকা সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর সুষ্ঠু কর্মপরিচালনার নিমিত্তে একটা নির্ধারিত সংখ্যার স্বাস্থ্য-জনবল (চিকিৎসক, নার্স ও বিভিন্ন ধরনের মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট) নিয়োজিত করা হয়। এর স্ট্যান্ডার্ড অনুপাত হলো এক জন চিকিৎসকের বিপরীতে তিন জন নার্স এবং পাঁচ জন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট থাকতে হবে। ২০১১ সাল থেকে দেশের অনুমোদিত জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির ঘোষণাও তাই আছে। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে — সরকারি ব্যবস্থাপনার অধীনে ৭৩ হাজার চিকিৎসকের বিপরীতে ৪৬ হাজার নার্স এবং ১৩ হাজার মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট রয়েছেন। জনবলের রেশিওটা উল্টে গিয়ে একদম ম্যাজিক ব্যবস্থাপনা যাকে ব'লে তা-ই হচ্ছে এখানে। বিদ্যমান এই ব্যবস্থাপনাকে বিশেষজ্ঞ এবং বিশেষভাবে অজ্ঞ যে সকল মহারথীরা যখন "চিকিৎসা সংকট" বলে অভিহিত করেন তখন আমি একমত হই কী করে? কারণ এটা তো মূলত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিগত সংকট! সরিষা দিয়ে মানুষ ভুত তারায় — কিন্তু প্রবাদ আছে যে, ঐ সরিষাতেই যখন ভুত ডুকে প'রে তখন সরিষা নিজেই ভুত হয়ে লোকজনকে ভোগায়-কাঁদায়! দেশের স্বাস্থ্যবিভাগের ব্যবস্থাপকেরা (আমলাতন্ত্র) মন্ত্রীর সমর্থন নিয়ে আমাদের জনগণের উপর সরিষার ভেতর ডুকে পরা ভুতের আচরণ করছেন। এর একটা কার্যকারণ যোগসূত্রও আছে। একটু খেয়াল করে দেখুন, আমাদের দেশে অসংখ্য বেসরকারি চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান এবং চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্রেক্টিসের দোকান রয়েছে। হেলথ সার্ভিসের ডিজি থেকে শুরু করে সরকারের স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি বাস্তবায়নের সাথে যুক্ত সকল চিকিৎসকই ঐ সমস্ত বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবার দোকানে-দোকানে সেবা বিক্রি করে থাকেন। যে কারণে উনারা তাদের দোকানে ক্লায়েন্ট বাড়ানোর অসৎ উদ্দেশ্য থেকে সরকারি হাসপাতাল গুলোতে ভারসাম্যপূর্ণ জনবল নিয়োগ না-দেয়ার কৌশল গ্রহণ করেন! একই কারণে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক থাকলে পর্যাপ্ত নার্স নেই — নার্স থাকলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা তথা যন্ত্রপাতি চালানোর প্রয়োজনীয় মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট নেই। এর মানে হলো, সেবা গ্রহীতাকে বেসরকারি চিকিৎসা সেবার দোকানে যেতে বাধ্য করা। এই অব্যবস্থাপনা বা একটা কর্মপদ্ধতিকে কৌশলে অকার্যকর করে রাখার প্রতিকার করার কেউ নেই। যিনি প্রতিকার করবেন তিনি মন্ত্রী — তিনি বধির হয়ে থাকেন হয়তো নিজের কমিশন প্রাপ্তির প্রত্যাশায়!
দেশে চিকিৎসা সংকট নয় — প্রকৃত সত্যটা হলো দীর্ঘ কয়েক যুগে তৈরী করা হয়েছে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সংকট। এই সত্যটা সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে। কোভিড-১৯ এর শুরু থেকে কয়েক দফায় যে পরিমাণে চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হলো, সেই অনুপাতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় জরুরি ভিত্তিতে মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট নিয়োগ না-দেওয়ার কারণ কি চিকিৎসা বাণিজ্য নয়? কমিউনিটি পর্যায়ে রোগপ্রতিরোধের জনবল শূন্যের কোঠায়। "চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম" — বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় এই কথাটি বড় বেমানান! শেখ হাসিনা একা সংগ্রাম করে কতটা পেরে উঠছেন আর কতটা পারছেন না — সে তো সকলের বুঝা উচিত। যার যার অবস্থান থেকে সবাই মানবিক হয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে না পারলে কোভিড-১৯ কাউকে ছেড়ে দিবে না।
লেখকঃ সমাজকর্মী ও মেধা-সংস্কৃতি বিকাশ সমাজকল্যাণ পরিষদ এর প্রতিষ্ঠাতা।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন