যাদের বাবা এখনো আছেন—ভাগ্যবান তারা
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক। ||
বাবা এক ছায়াময় মহীরূহ। তাঁর ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকলে গরম টের পাই না, ঝড় অনুভব হয় না। তাই তিনি থাকতে যতটা উপেক্ষিত, চলে গেলে ঠিক ততটাই অপরিহার্য হয়ে ওঠেন। যতদিন বাবা আছেন, আমরা অভ্যস্ত থাকি—তাঁর অস্তিত্বকে নিয়ে নয়, অনুপস্থিতির কল্পনাও করি না। কিন্তু একদিন সেই ছায়া যখন নিঃশব্দে সরে যায়, তখন বুকের ভেতর হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে।
যাদের বাবা এখনো আছেন—ভাগ্যবান তারা। তিনি পাগল হোন, জীর্ণ, দুর্বল বা অচল—তবুও তিনি বাবা। চারপাশে হাজারটা খারাপ পুরুষ দেখা যায়—দায়িত্বহীন স্বামী, স্বার্থপর ভাই, অসংবেদনশীল পুত্র। কিন্তু খারাপ বাবার সন্ধান মেলে না।
আমার বাবার সঙ্গে তোলা কোনো ছবিও নেই। শুধু পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছবির সাহসটুকু কখনো হয়ে ওঠেনি। আমাদের প্রজন্মের বাবারা ক্যামেরা চেনেন না, স্মার্টফোন বোঝেন না। অথচ সন্তানের মুখে একটুখানি হাসি ফোটাতে তাঁরা জীবন পর্যন্ত বন্ধক রাখতে পারেন।
তাঁরা সহজ মানুষ। অভাবী হয়েও সন্তানের জন্য অশেষ। নিজেরা না খেয়ে খাইয়েছেন, না পড়ে পড়িয়েছেন। ভবিষ্যতের জন্য কিছু রাখেননি, বর্তমানটা সন্তানকে দিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের সঞ্চয় কেবল সন্তানের স্বপ্ন, সন্তানের নিরাপত্তা, সন্তানের হাসি।
আমাদের বাবারা নিঃস্বার্থ ভালোবাসার আরেক নাম। তাঁরা স্বপ্ন দেখতেন না নিজের জন্য। সংসার আর সন্তান ছিল তাঁদের পৃথিবী। নিজের শখ-আহ্লাদকে নিঃশব্দে কবর দিয়ে হাসিমুখে দায় কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
সন্তানের চোখে ভবিষ্যতের ছায়া দেখতেন। সন্তানের আরাম-আয়েশের জন্য নিজেকে প্রতিনিয়ত সংকুচিত করে তুলেছেন। একটুখানি বেশি আয়, একটুখানি বাড়তি শিক্ষা, আরেকটু নিশ্চিত ভবিষ্যত—এই চাওয়ায় তাঁরা নিজেদের সর্বস্ব বাজি রেখে দিয়েছেন।
সন্তান যখন নিজের সংসারে প্রবেশ করে, তখন বাবা নিজেকে সেখানে বাড়তি ভাবতে শুরু করেন। সন্তানের ঘর আলাদা মানেই বাবার অবস্থান এক ধাপ পেছনে। চুপিচুপি নিজের জায়গা ছেড়ে দেন।
তিনি দোয়ার মানুষ হয়ে ওঠেন—আঁধারে বসে হাত তুলে বলেন, “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।” তিনি নিজের ঘর থেকে সরে গিয়ে সন্তানের সুখের কোলঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকেন—অদৃশ্য পাহারাদারের মতো।
বৃদ্ধাশ্রমের একাকীত্বেও তাঁরা সন্তানের জন্য কাঁদেন। জায়নামাজে বসে বলেন, “হে প্রভু! আমার ছেলেমেয়ে যেন নিরাপদে থাকে, ভালো থাকে।” একজন বাবাকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি কখনো তাঁর সন্তানকে অভিশাপ দিয়েছেন।
আমাদের প্রজন্মের বাবারা এখন বার্ধক্যের বন্ধনে ক্লান্ত। অনেকে চলে গেছেন পরপারে।আর যারা আছেন—তাঁদের শিশুসুলভ আচরণে আমরা যেন বিরক্ত না হই। আমাদের ব্যস্ত সময়ের মাঝখানে তাঁদের জন্য একটু সময় রাখি।
যাদের বাবা আর এই পৃথিবীতে নেই—তাঁদের জন্য যেন দোয়া থামে না। কারণ, সন্তানের ভালো কাজ, তার আত্মশুদ্ধি—সবই পৌঁছে যায় সেই বাবার আত্মায়। আল্লাহ নিজেই শিখিয়েছেন, কীভাবে বাবা-মার সঙ্গে কথা বলতে হয়, কীভাবে তাঁদের জন্য দোয়া করতে হয়।
বাবা এক মহামূল্যবান নিয়ামত। এই নেয়ামতের মর্যাদা না বুঝে কেউ যেন অবহেলার পাপ না করে। যে সন্তানের শরীর গঠিত বাবার শ্রম ও ত্যাগে, সেই সন্তান যদি সেই বাবাকে কষ্ট দেয়, তবে আরশও কেঁপে ওঠে।
বাবা থাকতে থাকতেই তাঁকে সম্মান করতে শিখতে হবে, নইলে পরজীবনে রয়ে যাবে দীর্ঘশ্বাস, অনুশোচনা আর আত্মগ্লানি।
প্রকৃতি নির্দয় নয়, কিন্তু ন্যায়পরায়ণ। যে সন্তান আজ বাবাকে অবজ্ঞা করে, কাল তার সন্তানও তাকেই তেমন আচরণে জর্জরিত করবে। বাবাত্বের উত্তরাধিকার একটা পবিত্র শৃঙ্খল—যারা শাখায় অবাধ্য হয়, তারা একদিন মূলেও ব্যথা পায়।
শেষ কথাটি যেন হৃদয়ে গেঁথে থাকে— প্রত্যেকটি বাবা ভালো থাকুন সন্তানের হৃদয়ে, রবের রহমতে। তাঁরা কখনো ফেরেশতা ছিলেন না, তবু সন্তানদের কাছে ফেরেশতার চেয়ে কম ছিলেন না—একটুও না।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন