সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা পুরোনো প্রকল্প ফাইলবন্দি

gbn

পাঁচ বছর আগে নীলফামারীর সৈয়দপুরে রেলওয়ের ক্যারেজ (বগি) তৈরির কারখানা নামে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। ভারতীয় ঋণ সহায়তার আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটির এখনও অনুমোদনই মেলেনি। সেই প্রকল্প বাতিল না করে দেড় গুণের বেশি টাকা খরচায় ‘অ্যাসেম্বল উপকারখানা’ নামে আরেকটি নতুন প্রকল্প শুরু করার তোড়জোড় চলছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে চার হাজার ১৯২ কোটি টাকা। বিনিয়োগকারীর খোঁজে রেলপথ মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে তৎপর হয়ে উঠেছে।

পুরোনো প্রকল্পের স্থবিরতা আর নতুন উদ্যোগের তৎপরতায় রেল যোগাযোগের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে দুটি প্রকল্প সমান্তরালে চালানো অনেক ঝুঁকির। এতে একদিকে অপ্রয়োজনীয় খরচ বেড়ে যায়, অন্যদিকে প্রশাসনিক সমন্বয়ে জটিলতা দেখা দেয়। বিনিয়োগকারীর মধ্যেও তৈরি হয় বিভ্রান্তি। আর নতুন প্রকল্পটি মূলত পুরোনো প্রকল্পের কাজের পুনরাবৃত্তি। অথচ পুরোনো প্রকল্পটি শেষ করতে পারলেই একই লক্ষ্য অর্জিত হতো।

রেলওয়ের একাধিক সূত্র জানায়, পাঁচ বছর আগের প্রকল্পটি থমকে যাওয়ার পেছনে ছিল তিনটি বড় বাধা। প্রথমত, ভারতের লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) থেকে অর্থ ছাড়ের প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে। দ্বিতীয়ত, প্রকল্পের প্রতি ধাপে নীতিমালা অনুসরণের জটিলতা এবং ক্রয়সংক্রান্ত নিয়ম মেনে চলতে গিয়ে প্রক্রিয়া আরও ধীর হয়ে যায়। তৃতীয়ত, সক্ষমতা যাচাই প্রতিবেদনে কিছু ত্রুটি ধরা পড়ায় তা সংশোধন ও পুনঃপর্যালোচনার জন্য প্রকল্প কার্যক্রম আবার পিছিয়ে পড়ে। ফলে মাঠে দৃশ্যমান কোনো কাজই হয়নি।  

পুরোনো প্রকল্পের স্বপ্ন 
পশ্চিমাঞ্চল রেলের প্রাণকেন্দ্র সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানাকে আধুনিকায়ন করে দেশে নিজস্বভাবে যাত্রীবাহী বগি তৈরির সক্ষমতা গড়ে তোলাই ছিল আগের প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য। ভারতীয় ঋণ সহায়তায় প্রকল্পের আওতায় ছিল অত্যাধুনিক যন্ত্র, কম্পিউটারনির্ভর উৎপাদন লাইন, আন্তর্জাতিক মানের গুণগত পরীক্ষা ল্যাব এবং প্রকৌশলী ও কারিগরি জনবল প্রশিক্ষণের দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি। পরিকল্পনা অনুযায়ী, বছরে অন্তত ১২০টি নতুন বগি তৈরির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল, যার বড় একটি অংশ দেশীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানির সুযোগও তৈরি করতে পারত।

বিস্তারিত নকশাসহ পূর্ণাঙ্গ প্রকল্প প্রস্তাব ২০২২ সালে পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেওয়া হলেও এখনও অনুমোদন পায়নি। প্রকল্পের প্রাথমিক ধাপের কাজের জন্য ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এরপর ভারতের এলওসি থেকে মূল অর্থ ছাড়ের প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে। 

বগি তৈরির কারখানা প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ও পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী কুদরত ই খুদা বলেন, প্রথমে এ প্রকল্পের জন্য পুরো কারখানার একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়। পরে সেই সমীক্ষার সঙ্গে বিস্তারিত নকশা যুক্ত করে রেল মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তবে ২০২২ সাল থেকে প্রস্তাবটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আটকে আছে। 

নতুন প্রকল্পের রূপরেখা 
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ আগের প্রকল্প বাতিল না করেই একই স্থানে ‘অ্যাসেম্বল উপকারখানা’ নামে আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর লক্ষ্য বছরে ৫০ থেকে ৬০টি নতুন যাত্রীবাহী বগি অ্যাসেম্বল (একত্র) করা। পাশাপাশি পুরোনো ও ক্ষতিগ্রস্ত বগি আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে সংস্কার এবং স্থানীয়ভাবে খুচরা যন্ত্রাংশ উৎপাদন সক্ষমতা গড়ে তোলা। এই উপকারখানায় আধাস্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি, কম্পিউটারনির্ভর ওয়ার্কস্টেশন, ভারী ধাতু কাটিং ও ওয়েল্ডিং মেশিন এবং মান নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা ল্যাব থাকবে।

কর্তৃপক্ষের দাবি, দ্বিতীয় প্রকল্পটি শুধু উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াবে না, বরং আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে রেলওয়ের জন্য দীর্ঘমেয়াদে খরচ সাশ্রয়ে ভূমিকা রাখবে। এর বিনিয়োগের জন্য ইতোমধ্যে দেশি-বিদেশি পুঁজিবাজারে সম্ভাব্য অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা চলছে। 

সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক শাহ সুফি নুর মোহাম্মদ বলেন, প্রকল্পটি দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকার কারণে নতুন করে কারখানা আধুনিকায়ন এবং সক্ষমতা বাড়ানোর প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এটি এখন সম্ভাব্যতা সমীক্ষার খসড়া অনুমোদন পর্যায়ে আছে। 

মাঠের চিত্র 
আগস্টের শুরুতে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, পুরোনো প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা বিশাল জমি এখন আগাছায় ঢেকে গেছে। শুধু দাঁড়িয়ে আছে একটি বিবর্ণ সাইনবোর্ড। তাতে লেখা প্রকল্পের নাম, সময়সীমা আর বাস্তবায়নকারী সংস্থার তথ্য। একসময় যেখানে আধুনিক কারখানা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল, সেখানে পড়ে আছে মরচে ধরা ভারী যন্ত্রাংশ; অনেকগুলো আংশিক খোলা কাভারের নিচে বৃষ্টি-রোদে ক্ষয়ে যাচ্ছে। 

১৮৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত সৈয়দপুর রেল কারখানায় মিটার ও ব্রডগেজ উভয় ধরনের কোচ মেরামত হতো। স্থানীয় চাহিদা পূরণে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সেখানকার দক্ষ প্রকৌশলী ও কারিগররা তৃতীয় শ্রেণির কোচও উৎপাদন করত।

একসময় বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে ‘সংকোচন নীতি’র কারণে কোচ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে দেশের চাহিদা পূরণে বিদেশি কোচ আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে রেলওয়ে।

রেলওয়ে কারখানার ট্রেড ইউনিয়ন নেতা শেখ রোবায়তুর রহমান বলেন, যে নামেই হোক এখানে নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে রেল পরিবহন ব্যবস্থায় সমৃদ্ধি আসবে। সেই সঙ্গে বাঁচবে সরকারের রাজস্ব।

যেভাবে কমতে পারে খরচ
বাংলাদেশ রেলওয়ের বার্ষিক কেনাকাটার তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, এক দশক ধরে দেশি-বিদেশি কোচ আমদানির ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল রেলওয়ে। প্রতিবছর ৬০-৭০টি যাত্রীবাহী কোচ বিদেশ থেকে আনা হয়। এ জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে শত শত কোটি টাকা বের হয়ে যাচ্ছে। শুধু ২০২৪ সালেই চীন থেকে ১০০টি নতুন কোচ আমদানি করতে খরচ হয়েছে প্রায় ৭২০ কোটি টাকা।

প্রকৌশলীরা বলছেন, সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় যদি আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তুলে উৎপাদন শুরু করা যায়, তাহলে একই ধরনের কোচ অর্ধেক খরচে তৈরি সম্ভব। তাদের হিসাবে, স্থানীয়ভাবে একটি কোচ তৈরি করতে খরচ পড়বে প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি টাকা। অর্থাৎ ১০০টি কোচ উৎপাদন করলে সাশ্রয় হবে ৩৫০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা।

জিবি নিউজ24ডেস্ক//

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন