“তোমায় ভালোবাসি” বলতে জিহ্বাই যথেষ্ট, কিন্তু সেটা উপলব্ধি করতে হয় মন দিয়ে
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।|
অনেকেই বলতে পারে, “ভালোবাসি।” তবে ভালোবাসার পথ, পদ্ধতি ও প্রয়োগ কেমন হবে—সেটাই আসল। যাদের ভালোবাসা মানে কেবল দেহের প্রতি তীব্র টান, সেটা মোটেও ভালোবাসা নয়; বরং তার অন্য নাম আছে।
কোনো কোনো সম্পর্কের নাম শুনলে মনে হতে পারে সেখানে ভালোবাসা আছে, তবে তাতে ভালোবাসা নাও থাকতে পারে—কেবল অভ্যাস। নিয়মনীতি, লৌকিকতা এবং সামাজিকতা যে সম্পর্কের গাঁথুনি মজবুত রাখে সেখানে ভালোবাসা থাকতেও পারে, আবার নাও থাকতে পারে। ভালোবাসা আসলে অন্য এক আবেশের উপলব্ধি—না থাকার পরেও টান অনুভব করা, অনুপস্থিতিতে শূন্যতা ভর করা, কোনো মোহ-লোভ ব্যতিরেকে সারাক্ষণ অস্তিত্বের সাক্ষী থাকা- এইতো।
চারদিকে প্রেমের হাটবাজার। ভালোবাসার গান-কবিতা। শরীরের আকর্ষণ ছাপিয়ে সেটা যদি মন পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারে, তবে তার মূল্য নেই। শরীরের আকর্ষণ সময়ের সঙ্গে উঠে যায়, বিতৃষ্ণা চলে আসে। পাশাপাশি অবস্থানেও অস্বস্তি অনুভব হতে পারে— সেখানে সব কিছু থাকে, কেবল ভালোবাসা ছাড়া।
“তোমায় ভালোবাসি” বলতে জিহ্বাই যথেষ্ট, কিন্তু সেটা উপলব্ধি করতে হয় মন দিয়ে, বিশ্বাস রাখতে হয় গোটা অস্তিত্বে। প্রায়োরিটি ঠিক করে প্রিয়জনের সীমারেখা। কোন সম্পর্ক স্বার্থের, কোনটা সময় কাটানোর, আর কোনটা প্রলোভনের—তা বুঝতে বেশি সময় লাগে না।
শরীরে টানে দুই তীর কাছাকাছি হলে ভোর ফোটার আগেই তা আলাদা হয়ে যায়। বালুচরের কাটাকাটি আরেকটি ঢেউ আঁচড়ে পড়ার পর সেই বালুকণায় স্মৃতি রাখে না। ভালোবাসার সবচেয়ে বড় শক্তি বিশ্বাস—যেখানে কোনো লৌকিকতা বা অভিনয় থাকে না।
শত ব্যস্ততার মাঝেও যার শূন্যতা অনুভব হয়, দুঃখের সময়ে যার অনুপস্থিতি সবার আগে মনে পড়ে কিংবা সুখের সময় যাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মনে হয়—সেটাই ভালোবাসা। সব প্রয়োজন উপেক্ষা করে যার হাত ধরলে, চোখে চোখ রাখলে পৃথিবীর সব সুখ নেমে আসে, প্রকৃতি সাত সুর বাজায়, মনে হয়—এই তো জীবনের পরমার্থ।
ভালোবাসা অমর হওয়া শর্ত নয়; তবে সেখানে শঠতা, ভয় এবং বাণিজ্য থাকবে না। ভালোবাসায় থাকবে আত্মবিলীনের অধিকার। জন্মের পর জীবন সবকিছুর আগে অনুভব করে একরত্তি ভালোবাসার প্রয়োজন। ভালোবাসা আসলে জীবন বাঁচিয়ে দেয়।
জীবনে সব জুটেছে—কেবল খাঁটি ভালোবাসা ছাড়া? তব জীবন মাটির অপেক্ষাতেই আছে। ভালোবাসা পাওয়ার পূর্বশর্ত হলো—শর্তহীনভাবে ভালোবাসা। ভালোবাসা কেবল মানুষের মধ্যেই আছে—এটা একমাত্র সত্য নয়; একাকিত্ব, বই, গান, নিরবতা কিংবা প্রকৃতি—সবই ভালোবাসার ভিন্ন ধরণ।
আপনি কার সঙ্গী—সেটাই আসল বিবেচ্য। পাহাড়ে চড়া, সাগরে ভেজা, আড্ডায় জমা আর শূন্যতায় শোকসভা করা জীবনের অধিকার। যারা নিজের ওপর অত্যাচার করে, নিজেকে বঞ্চিত করে বাউণ্ডুলে জীবনের উপভোগ্য পরিণতি থেকে—তারা ভালোবাসার আসল মানে জানে না।
ভালোবাসা পেতে হলে ভালোবাসতে জানতে হয়। ভোরের সূর্য ভালোবাসে শিশিরবিন্দুকে, যেমন কাজের ছেলেটি ভালোবাসে কাজে ফাঁকি দেওয়াকে। জীবন দু’দিনের—জীবন যেদিন পক্ষের, সেদিনও ভালোবাসতে হবে; জীবন যেদিন বিপক্ষের, সেদিনও ভালোবাসতে হবে। উপেক্ষা করলেই জীবন অবরোধ টেনে দেবে।
ভালোবাসার পদ্ধতিটা আবিষ্কার করতে পারলেই জীবন ফুল-কুঁড়িতে ভরে উঠবে। মনের মধ্যে গান শোনাবে কোকিল-শ্যামা, চিত্তে নৃত্য করবে দোয়েল-পাপিয়া। যেদিন ভালোবাসার অনুভূতি ঠিকঠাক মনের ঘরে জাগবে, সেদিন বুকের মধ্যে ফুটবে পৃথিবীর সব রঙিন ফুল। ছড়াবে দুনিয়ার সবচেয়ে বিশুদ্ধ সুবাস। আবাস হবে মেঘের ভেলায়- আজ আমার কোথাও যেতে নেই মানা।
নিজেকে মনে হবে দেবতার ছায়া, দেবীর আগমনে ধন্য ধন্য হবে হৃদয়ের আঙিনা। একজীবনে মানুষ সবচেয়ে বেশি ভোগে ভালোবাসার খরায়— অথচ তা থাকে নাকের ডগার চেয়েও কাছে। অহমের দেয়াল তুলে আমরা তা ধরতে যাই না। আমিত্ব গ্রাস করে সবকিছু। হৃদয়ের আভরণ হয়ে নেমে আসে কালো ছায়া। অথচ দুনিয়াটা মায়ায় ভরা ছিল।
মানুষ সবকিছুতেই ব্যবসা খুঁজে নিজেকেই বিক্রি করে দিয়েছে সবার আগে। নয়তো পূজিত হওয়ার মতো হৃদয় সবার মাঝেই ছিল। যে নিজেকেই ভালোবাসেনি, সে অন্যকে ভালোবাসবে বা ভালোবাসা পাবে—প্রশ্নই আসে না।
আমাদের প্রার্থনায় বেজে উঠুক ভালোবাসার বিশুদ্ধ সুর। ভালোবাসাহীন ভুবন বেশিদিন টিকবে না। স্রষ্টা ও সৃষ্টির যে ভালোবাসা, তা আদিম হোক—আদি ও অন্ত বিস্তৃত হোক মানুষের দয়া। ভালোবাসারে ভালোবাসিবার দিয়ে তুলে নিও ভালোবাসার ফসল।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন