একই রুমে তাঁরা এখন আর ‘বনলতা সেনের সঙ্গে মুখোমুখি বসিবার’ অবস্থাতেও নেই
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।|
চাকরিতে এক যুগ পেরিয়ে গেছে, অথচ সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কয়েকটি ব্যাচের সদস্যরা এখনও প্রভাষক পরিচয়ে আছেন— এই লজ্জা রাষ্ট্রের। পাঁচ বছরের পদোন্নতি নিয়মের মারপ্যাঁচে আট বছরে নিয়ে সেই পদোন্নতির ট্রেন বারো বছরেও গন্তব্যে পৌঁছায়নি— রাষ্ট্রের চালক হিসেবে সরকারের কোনো কৈফিয়ত আছে? শিক্ষামন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর— এ বিষয়ে কোনো ভাষণ দেবেন?
একদিকে অসম্মানজনক আত্মপরিচয়ের গ্লানি, অন্যদিকে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি— রাষ্ট্র আন্তরিক হলে এসব থেকে শিক্ষকদের মুক্ত রাখতে পারত না? বারো বছরের দীর্ঘ সময়ে অন্য ক্যাডারভুক্তদের দু’টি প্রমোশন প্রাপ্তির পরে তৃতীয় প্রমোশনও প্রায় ডিউ হয়! অথচ শিক্ষক চিরকাল শিক্ষক! মুখে মুখে সম্মানের ঝাঁপি দিয়ে ঢেকে রাখে, কিন্তু ন্যায্যটুকুও কেড়ে নেওয়ার আলামত থাকে!
পদোন্নতি-বঞ্চিত এই শিক্ষকগণ এখনো কর্মস্থলে নিয়মিত যাতায়াত করেন, ক্লাস কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন এবং রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুন মেনে কর্তৃপক্ষের কাছে পদোন্নতির আবেদন করেন— এটা শিক্ষকসুলভ আচরণ। এজন্য সরকার শিক্ষকদের ধন্যবাদ দিতে পারে। এমন ধৈর্যশক্তির অধিকারীদের রাষ্ট্র আর কোন সেক্টরে পাবে? দুর্বলকে সবাই এক চাপ দিয়ে যায়, এখন রাষ্ট্র দিচ্ছে পিষে।
শিক্ষকদের সুবিধা ও অসুবিধা দেখভালের জন্য একটি অধিদপ্তর এবং ডিজি, গোটা মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী, সচিব ছিলেন এবং আছেন; তবুও দীর্ঘ ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও এই জটের রহস্য কোনো লৌকিক ব্যাখ্যায় কাউকে যৌক্তিকভাবে সন্তুষ্ট করতে পারবে? রাষ্ট্র যদি শিক্ষকদের প্রাপ্য দিতে না পারে, সম্মান করতে না জানে, তবে ঋণ ও নীতির ভগ্নদশা কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে না। এমন তো নয় যে, পদোন্নতি-বঞ্চিত ক্যাডারগণ বাড়তি কিছু চাইছেন! তাদের ন্যায্যতা বুঝিয়ে দিতে এই গড়িমসির কারণ বুঝি না! রাষ্ট্রের স্বপ্রণোদিত হয়েই হেতু উদ্ভাবন করা উচিত। কোনো অদৃশ্য জিন বা ভূতের আঁচড় আছে নাকি?
একই বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে অন্যান্য ক্যাডারের ব্যাচমেটগণ বহুদূর চলে গেছেন, অথচ পদোন্নতি- বঞ্চিত শিক্ষকগণ নিজের পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত হন। এদের অনেকেই এখন সামাজিকতা এড়িয়ে চলেন! কী করে সমাজকে বলবেন, ১২ বছর পরেও বেচারারা এখনো প্রভাষকের গণ্ডিতে আটকে আছেন? সমালোচকরা এই পদের নাম এখন ‘প্রভাশোক’ রাখতে চান! একই ব্যাচের একই ক্যাডারে, অথচ কেউ কেউ চার বছর আগে পদোন্নতি পেয়ে সহকারী অধ্যাপক হয়েছেন, আর কেউ এখনো প্রভাষক। সার্ভিসের শৃঙ্খলা কী এমনই হয়?
একই রুমে তাঁরা এখন আর ‘বনলতা সেনের সঙ্গে মুখোমুখি বসিবার’ অবস্থাতেও নেই। বঞ্চিতরা নিজেদেরকে বিপন্ন মনে করেন। শিক্ষকতা তো আনন্দের পেশা। সেখানে শিক্ষকদের এমন হতাশায় রেখে রাষ্ট্র কী আশা করে? রাষ্ট্রীয় দ্বৈতনীতির লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছেন শিক্ষক! কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা থাকলে যোগ্যদের পদোন্নতি দেওয়া কি কঠিন কোনো কাজ? পাঁচ আগস্টের পরে অধ্যাপক এবং সহযোগী অধ্যাপকের একস্লটের পদোন্নতি হয়েছে। তাও অনেক দেনদরবারের পরে, প্রায় আদায় করে নিতে হয়েছে!
রাষ্ট্র কী চায়— সব ব্যাপারে আন্দোলন হোক? বিশৃঙ্খলা জমে থাকুক? না চাইলে কেউ কিছু পাবে না— এমন কিছু? পদোন্নতির জন্য শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের ব্যানার নিয়ে রাস্তায় দাঁড়াতে হচ্ছে, আল্টিমেটাম শোনাতে হচ্ছে— এটা কী রাষ্ট্রের কাছে শোভনীয় কিছু? ন্যায্য দাবি-বঞ্চিত এই শিক্ষকগণ শ্রেণিকক্ষের ডায়াসে দাঁড়িয়ে কীভাবে প্রজন্মকে আত্মবলে বলীয়ান হওয়ার স্বপ্ন দেখাবেন?
যারা আজ রাস্তায় দাঁড়িয়েছেন, তারা তো একান্তই নিরুপায়। এদের সমালোচনাও করতে পারেন, কিন্তু ভিন্ন কোনো উপায় বলুন! পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে একেবারে। অস্তিত্ব সংকটে পড়লে তখন আর কী করার? রাষ্ট্র কি এই সংকট সৃষ্টির পূর্বেই সমস্যার সমাধান করে দিতে পারত না? শিক্ষকদের বঞ্চিত করে, অসম্মানের অপপ্রয়াস দেখিয়ে আসলে কী হাসিল করতে চায়? শিক্ষকদের ঠকিয়ে প্রজন্মের মধ্য দিয়ে কী অর্জন করা যায়? জাতির মেরুদণ্ডে শক্তি প্রদানকারী শিক্ষককেই যদি দুর্বল করে রাখা হয়, তবে জাতির সামনের অমানিশার অন্ধকার কী করে দূর হবে?
যোগ্যদের স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হোক। নির্ধারিত সময়ের পরেই যদি বেতনস্কেলের পরবর্তী ধাপে পদার্পণ নিশ্চিত হয়, তবে কেউ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কোনো কর্মজীবীকে আর্থিকভাবে বঞ্চিত করে এবং সামাজিকভাবে অসম্মান করে রাষ্ট্র সুষ্ঠু সেবা পাবে না।
দীর্ঘদিন প্রভাষক হিসেবে কর্মরত থাকার ফলে মানসিক অবসাদ সৃষ্টি হয়, যা কর্মক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলে। ব্যক্তিগত জীবনেও নাজুক পরিস্থিতির উদ্রেক করে। মানুষকে তো সামাজিক জীব হয়ে বাঁচতে হয়। রাষ্ট্র যদি অচিরেই উদ্যোগী হয়ে এই সংকটের সমাধান না করে, তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থায়ী স্থবিরতা নেমে আসার আশঙ্কা আছে। রাষ্ট্র ন্যায্য দাবি আমলে নিক এবং ভবিষ্যতে যাতে পদোন্নতি-বঞ্চনার মাধ্যমে কোনো সংকট সৃষ্টি না হয়, সেটারও প্রতিশ্রুতি দিক।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন