হুসনা খান হাসি ||
সেকালে সময় ছিল ধীর, কথার ছিল ওজন, সম্পর্কের ছিল মাধুর্য। তখন সম্পর্ক গড়ে উঠত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, পরিচয় হতো মাটির গন্ধে মিশে, চোখের ভাষায় প্রকাশ পেত আন্তরিকতা। কেউ কারও পাশে বসলে নীরবতাও কথার মতোই প্রাণবন্ত ছিল। সময় যেন মানুষের হাতের মুঠোয় ছিল না, বরং মানুষই সময়ের সঙ্গী হয়ে বাঁচত। সন্ধ্যার দিকে সবাই মিলে বসত, গল্প হতো, চায়ের ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে যেত হাসির শব্দ। হয়তো আলো কম, কিন্তু মন ছিল আলোয় ভরা। সেকাল ছিল এক আবেগের যুগ, যেখানে সময়ের ধীর গতি মানুষকে শেখাতো বোঝার শিল্প, আর জীবনের অর্থ খুঁজে নিতে শেখাতো ছোট ছোট মুহূর্তে।
চিঠি লিখে মানুষ অপেক্ষা করত দিনের পর দিন, শুধু একখানা উত্তর পাওয়ার আশায়। অপেক্ষার প্রতিটি দিনেই ছিল এক ধরনের মাধুর্য, এক ধরনের নিশ্চয়তা। চোখের ভাষা বোঝার জন্য কারও স্ক্রিন দরকার হতো না, হৃদয়ের যোগাযোগ ছিল চোখে চোখে, হাসিতে হাসিতে, ভালোবাসা মানে ছিল ধৈর্য, শ্রদ্ধা, আর গভীর বোঝাপড়া। কারও একটি “চিঠি এসেছে” খবরেই হৃদয়ে যে আলো জ্বলত, তার উজ্জ্বলতা হয়তো আজকের তীব্র আলোয়ও পাওয়া যায় না।
একাল অন্যরকম। এখানে সময় দৌড়ায়, মানুষ দৌড়ায়, সম্পর্কও যেন দৌড়ে চলে যায় হাতছাড়া হয়ে। ভালোবাসা যেন হয়ে গেছে এক ধরনের দ্রুত চুক্তি, যেখানে আবেগের জায়গা নেই, আছে শুধু সময় বাঁচানোর হিসাব। আমরা বলি “অনলাইন”, কিন্তু প্রকৃত সংযোগটা কোথায় হারিয়ে গেছে কেউ জানে না। এখন ভালোবাসা মাপা হয় ‘রিপ্লাই টাইম’ আর ‘লাস্ট সিন’-এ। কথার চেয়ে ইমোজি বেশি ব্যবহৃত হয়, আর নীরবতা যেন এক ভয়ানক ফাঁদ। মানুষ আছে, ভিড় আছে, কিন্তু সংযোগের গভীরতা নেই। একে অপরের দিকে তাকানো বদলে গেছে স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকার অভ্যাসে। একালে সবকিছু দ্রুত। সময় যেন কাউকে সুযোগই দেয় না থামার, বোঝার, অনুভব করার। মানুষ কথা বলে, কিন্তু শোনে না। হাসে, কিন্তু চোখে থাকে ক্লান্তি।
বেরেহম এই কাল, কারণ সে মানুষকে গতি দিয়েছে কিন্তু শান্তি কেড়ে নিয়েছে। প্রযুক্তি দিয়েছে গতি, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে অপেক্ষার সৌন্দর্য। সহজলভ্যতার ভেতর হারিয়ে গেছে আকাঙ্ক্ষা, আর দ্রুততার ভেতর বিলীন হয়েছে ধৈর্য। এখন ভালোবাসা মানে ‘চ্যাট হিস্টোরি’, বন্ধুত্ব মানে ‘ফলোয়ার লিস্ট’, আর নৈঃশব্দ্যের মানে হয় ‘ডিসকানেকশন’।
আজকের মানুষ একসঙ্গে থেকেও একা। চারপাশে আলো, শব্দ, রঙ, কিন্তু মনে এক অব্যক্ত শূন্যতা। আমরা অনেক কিছু জানি, কিন্তু খুব কম কিছু অনুভব করি। প্রযুক্তি আমাদের দিয়েছে যোগাযোগের হাজার উপায়, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে অনুভবের গভীরতা। এক ক্লিকে আমরা কথা বলতে পারি দূর মহাদেশে, কিন্তু একই ঘরে বসে কেউ কারও চোখে তাকানোর সময় পাই না।
সত্যিই, একালের সময় বড়ই বেরেহম কাল!
বেরেহম এই কাল–কারণ সে আমাদের থেকে নিয়ে নিয়েছে সেই মূল্যবান সময়, যে সময়টায় আমরা মানুষ হয়ে উঠতাম ধীরে ধীরে। এখন সবকিছুই দ্রুত, সোজা, কার্যকরী, কিন্তু এই কার্যকারিতার ভেতর কোথাও যেন হারিয়ে গেছে কোমলতা, হারিয়ে গেছে সেই ‘অপ্রয়োজনীয় অথচ দরকারি’ সময়।
তবু, একালের সব কিছুই যে নিষ্ঠুর তা নয়। এই একালের মধ্যেও আলো আছে। এখনো কিছু মানুষ আছে যারা সময়ের ভেতরও থামতে জানে, অপেক্ষা করতে জানে, নীরবতাকে ভয় পায় না। হয়তো তাদেরই জন্য এই পৃথিবী এখনো টিকে আছে। হয়তো একালের এই তীব্রতার ভেতরেই সেকালের কোমলতার কোনো এক সুর এখনো টিকে আছে নিঃশব্দে, বাতাসের ভেতর, কোনো চায়ের কাপের পাশে, কোনো নরম কথার আড়ালে।
সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাই মনে হয়, সেকাল হারিয়ে গেছে, কিন্তু তার ছায়া এখনো আমাদের ভেতরে বেঁচে আছে। একালের ব্যস্ততা যতই কঠিন হোক, মানুষের হৃদয় এখনো খোঁজে সেই ধীর ছন্দ, সেই নরম সম্পর্ক, সেই স্পর্শহীন উষ্ণতা।
সত্যিই, সময় বদলেছে। কিন্তু ভালোবাসার অভিপ্রায় কি কখনও বদলায়? হয়তো না। হয়তো মানুষ আজও, এই তীব্র একালের ভেতরেও, খুঁজে ফেরে সেই হারিয়ে যাওয়া সেকালের মাধুর্য।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন