আলেমদের আত্মসমালোচনার সংকট

gbn

কতিপয় আলেমের উদ্ভট ফতোয়ায় সমাজ অস্থির ও অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে

রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।|

বর্তমান সময়ে আলেমদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো সংকট- আত্মসমালোচনার অভাব। তারা একটা কিছু করলে, বললে সেটা প্রতিষ্ঠা করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠা তাদের স্বভাব। সেটা ভুল হোক কিংবা বাতিল হোক, নিজের ভুল স্বীকার করার বিরল দৃষ্টান্ত জাহির না করার রীতি মেনে চলেছে। কোনো ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরেও তাদের মতের স্বপক্ষে দুর্বল কিংবা মনগড়া দলিল হাজির করছে। অকাট্য যুক্তিও কারো কারো গোঁড়ামির কাছে নাজেহাল। মাইকে বিষোদ্‌গার করা, মনোমতো ফতোয়া দেওয়া এবং স্বার্থকে সম্মুখে রাখা- দিন দিন এসব ধর্মকে কৌতুকে পরিণত করছে। 

 

কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুঃখের হলেও সত্য, কতিপয় আলেম ধর্মকে তাদের ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে ব্যবহার করতে গিয়ে ধর্মের নিজস্বতা ও সুমহান মহিমাকে কলঙ্কিত করছেন। সাধারণ ধর্মপ্রাণদের কাছে ধর্মকে আতঙ্ক বা ভয়ের বস্তু হিসেবে পরিচিত করছে। দিন দিন ধর্ম হয়ে উঠছে ব্যবসার মূলধন। ধর্মভিত্তিক অসহিষ্ণুতা অসহনীয় মাত্রা পেয়েছে। কাফের ফতোয়া দিয়ে, জান্নাত বিক্রি করে কেউ কেউ রুজি রুটির জোগাড়ে নেমেছে। অধার্মিক ফতোয়া দিয়ে মানুষ হত্যা, স্থাপনা ভাঙা এবং লুটপাটের মতো ঘটনাও ঘটছে। ধর্মে ধর্মে সংঘর্ষ স্বাভাবিকতার রূপ পরিগ্রহ করেছে। এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে একদল। 

 

দাঁড়ি, টুপি এবং যুব্বা- এই তিনটে থাকলে কাউকে আলেম ধারণা করা সংগত। মানে প্রচলিত পরিচিতিতে আলেমের জন্য এগুলো থাকা আলেমি আলামতের বহিঃপ্রকাশ। তবে কারো মধ্যে এ তিনটি থাকার পরেও তার আলেম না হওয়ার একশ কারণ থাকতে পারে। সমাজে প্রচলিত আলেম হওয়ার বাহ্যিক বিশ্বাসককে কেউ ফ্যাশন হিসেবে, কেউ স্বস্তি হিসেবে, আবার কেউ ব্যবসা হিসেবে ধারণ করছে। ভিক্ষুকের ভিক্ষাবৃত্তিতেও ধর্মীয় পোশাক জায়গা নিয়েছে। সাধারণ মানুষের সিমপ্যাথি আদায়ে ধর্মীয় লেবাসের আবেদন আছে। ভণ্ডরা এই সুযোগকে তাদের স্বার্থ হাসিলে কাজ লাগাচ্ছে।  

 

তবে প্রকৃত জ্ঞানের যে মহড়া মনের মধ্যে থাকা দরকার তা অনেকক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। আলেমগণ অনুপ্রেরণার হবেন। সমাজের সাধারণদের জন্য তাদের মধ্যে অনুসরণীয় বিচরণ থাকবে। তাঁদের আচরণে সহানুভূতি, সহমর্মিতা উপস্থিত থাকবে। সততা ও সত্যবাদিতা তাদের পোশাকের মতো হবে। অসাম্প্রদায়িকতা তাঁর চেতনাগত হবে। আমানতদার ও বিশ্বস্ত হিসেবে তারা আলামিনের উত্তরসূরি হবেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চারে এবং ন্যায়ের পক্ষে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরে তারা মহান হয়ে উঠবেন। কিন্তু সমাজের বাস্তব চিত্র ভিন্ন। ধর্ম এখন মাজার ভাঙার ইজারাদার হয়েছে! 

 

কতিপয় আলেমের উদ্ভট ফতোয়ায় সমাজ অস্থির ও অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। ডামি বন্দুক দেখিয়ে ক্ষমতার জানান দেওয়া নেশার মতো হয়ে গেছে। প্রতিবাদ এখন প্রতিহতের রূপ পরিগ্রহণ করেছে। মসজিদের মিম্বরে কিংবা মজমার মাইকে অন্যের চরিত্রহনন, গিবত এবং শিকায়েত করা স্বভাবে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মতো ব্যর্থ, ভঙ্গুর ও বর্বর রাষ্ট্রকে বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও লক্ষণীয়। 

 

সামাজিক অস্থরতা ও অশান্তি উসকে দেওয়ার অন্তরালে কয়েকটি নাম বারবার উঠে আসছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং মাঠে-ময়দানে এরা ধর্ম প্রচারের নামে উগ্রতা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আশঙ্কার কথা, দিনে দিনে এদের মতাদর্শের অনুসারী বাড়ছে। সুরতে তারা আলেমের মতো দেখতে হলেও সিরাতে কতটুকু আলেম আর কতখানি জাহেল তা বিবেচনার দাবি রাখে। যাদের উদ্দেশ্যই উগ্রতা ছড়ানো এবং সমাজে অস্থিতিশীলতা জারি রাখা- তাদের অবস্থান সন্দেহজনক। আলেমদের নিজেদের আত্মসমালোচনা বাড়ানো দরকার। ধর্মের নামে সংগঠিত অন্যায়কে প্রতিহত করাও তাদের দায়ের মধ্যে পড়ে। 

 

সাধারণ মানুষ ভুল করলে তাতে ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু অলেমগণ ভুলপথে চললে তাতে কওম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কথিত তৌহিদপন্থী জনতা এখানে ইতোমধ্যেই ইসলামের ভ্রাতৃত্ববোধের যে সর্বনাশ করেছে, সেটার ঘাটতি মেটাতে কয়েক যুগ লাগবে। তৌহিদী জনতাকে যারা আগ্রাসী করে তুলছে তারা ইসলামের সম্প্রীতি ও মমত্ববোধের শিক্ষার সাথে অপরিচিত। তার ধর্মের নামে জাহেলিয়াত চর্চা করতে চায়। তাদের উদ্দেশ্য সমাজের জন্য আদৌ মঙ্গলজনক নয়। তারা বিশৃঙ্খলা ঘটিয়ে ফায়দা হাসিল করার খায়েশে ঝুঁকছে। সমাজের ভাইরাল রীতি তাদেরকেও ব্যাধিগ্রস্ত করেছে। মানব প্রবণতার অন্ধকার দিক থেকে মুক্ত থাকতে না পারলে ধর্ম শিক্ষাও অর্থহীন।  

 

উগ্রতা মাদকের মতো। রাজনৈতিক ও গোষ্ঠিস্বার্থ মেটাতে এটা মরণাস্ত্রের মতো কার্যকর! অথচ যারা এই অস্ত্রের অপব্যববহার করছে তারা জেনেশুনেই ধর্মের ক্ষতিতে নিজেদেরকে শামিল করছে এবং কওমকে বিপথগামী বানাচ্ছে। এটা একটা সময় অপ্রতিরোধ্য হবে এবং উদ্ভাবকদেরকেও ধ্বংস করে ছাড়বে। আলেমদের মধ্যে সমালোচনা সহ্য করার অভ্যাস ও স্বভাব না থাকা ধর্মের মূল শিক্ষা ও চেতনার পরিপন্থি। শোধরাতে না চাওয়ার স্বভাব একমাত্র শয়তানের। প্রকৃত আলেমগণের আলামতই তওবা তথা অনুশোচনা। সমাজের আলেমদের মধ্যে অনুশোচনা চিত্র প্রতীয়মান। নাকি একরোখা মনোভাব দৃশ্যমান?

 

আলেমের শক্তি শুধু এলেম নয়, বরং আমলও। ভালো যখন পচে তখন সেটা সীমাহীন দুর্গন্ধ ছড়ায়। মন্দের মাতলামি সহ্য করার সম্ভব হলেও ভালোর অন্ধকার মেনে নেওয়া অসম্ভব। ধর্ম কেবল ধার্মিকদের কাছেই নিরাপদ। বকধার্মিকদের কবল থেকে ধর্মের জিম্মিদশা ছাড়িয়ে ধর্মের সু-মহান বাণী সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। ধর্ম যে ভ্রাতৃত্ববোধ, মানবিকতা, সহনশীলতা ও সহমর্মিতার কথা বলে তা এখন এই সমাজের সবচেয়ে বেশি দরকারি। 

 

যারা ধর্মের অপব্যাখ্যা করে বিতর্ক উসকে দেয় তাদেরকে প্রতিহত করতে হবে। তাদের ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে এবং তারা কারো অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের ধর্মের মুখোশে আছে। আমলদার আলেমদেরকে সমাজের নেতৃত্বে জায়গা দিতে হবে। সুষ্ঠু পরিবার গঠন, সমাজ পরিবর্তন ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে আলেমের আলো কাজে লাগাতে না পারলে অন্ধকার দূর হবে না। এজন্য আমল আলেমদের এগিয়ে আসতে হবে। ভালো মানুষ যখন সমাজ ও রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দিতে গাফিলতি করে তখন মন্দরা অগ্রভাগে যাওয়ার সুযোগ পায়। যা জাতির জন্য আত্মঘাতী।  

 

আলেমদের আত্মসম্মান বাড়ুক। কেবল ধর্মের কাছেই তাদের আত্মসমর্পণ হোক। আত্মসমালোচনা মাধ্যমে পরিশুদ্ধি অর্জন ছাড়া বিকল্প নাই। কথিত আলেমশ্রেণীর ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা বিমুখতা জারি থাকলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে সভ্যতা। ধর্মের নামে যারা বিতর্কিত কাজ করে, ধর্মকে পুঁজি করে অসৎ ও অবৈধ উপায়ে যারা রুজি করে তাদের দৌরাত্ম্য থামাতে হবে। ধর্ম কোনো দুনিয়াবি ব্যবসায়ের মূলধন নয়। এটা মানবমুক্তির পয়গাম নিয়ে এসেছে। পয়গম্বররা সারাজীবন মানুষকে আমন্ত্রণ করেছে সত্যের পথে এবং বিদ্রোহী হতে আহ্বান করেছে মিথ্যার বিরুদ্ধে। 

 

সমাজ ও রাষ্ট্রের আলেমরা মিথ্যা, জরা ও আত্মার ব্যাধি মুক্ত হলে সমাজে বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী হবে। 'যুগ জমানা পাল্টে দিতে চাইনে বহুজন/এক মানুষেই আনতে পারে জাতির জাগরণ।'- কবির ভাষার এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে সমাজে খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহ. কিংবা শায়খ আহমাদুল্লাহদের মতো আলেমের সংখ্যা বৃদ্ধি পাক। আলেমদের মর্যাদা কেবল আলেমরাই টিকিয়ে রাখতে পারে। সেটা টিকে থাকবে তাদের কথা, কাজ ও বিশ্বাসের সমন্বয়। আলেমসমাজ সবসময়ে সাধারণের নজরদারিরতে থাকে। কাজেই তাদের জন্য এমনকিছু করা, বলা শোভনীয় নয় যাতে গোটা সম্প্রদায়ের ওপর কালিমা লেপন করে।

 

 

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন