যারা অবৈধ উপায়ে, ঘুষ-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি বা রাজনৈতিক আনুগত্যের মাধ্যমে শিক্ষক হয়েছেন—
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।
শিক্ষকদের দুর্নীতি কেবল টাকা-পয়সার এদিক-সেদিক করা দিয়েই মাপা যায় না। কতিপয় শিক্ষকও দুর্নীতিবাজ, আর তাদের দুর্নীতিই জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার আয়োজন করে। ক্লাসে না যাওয়া, ঠিকমতো ক্লাস না নেওয়া কিংবা শ্রেণিকক্ষের ডায়াসকে প্রাইভেটের বিজ্ঞাপনমঞ্চে পরিণত করা এসব অপরাধ হিসেবে হয়তো ছোট মনে হতে পারে কিন্তু এগুলিই জাতি বিনাশের প্রথম ও প্রধান ভয়ঙ্কর পেরেক।
অনেক শিক্ষক আছেন, যাদের পাওয়া যায় সর্বত্র— তারা নেতা, রাজনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক কিংবা ব্যবসায়ী। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তারা নিয়ম করেই অনুপস্থিত। টিচার্স লাউঞ্জে, ক্লাবে, দফতরে কিংবা হেডের রুমে তেল মালিশে তাদের দেখা মিললেও ক্লাসরুমে তারা নাই। শিক্ষার্থীরা তাদের পায় না, অনেককে তো চেনেই না।
কিছু শিক্ষক আছেন, যারা ভালো শিক্ষক— তবে কেবল প্রাইভেট টিউশনিতে। শ্রেণিকক্ষ তাদের কাছে যেন বিরক্তির প্রতীক। সরকারি হাসপাতালের এক চিকিৎসকের মুখে শুনেছিলাম, “ওটিরুমের সরঞ্জাম ভোঁতা!" ওরা পরিহাস্যে বলে, সেই ডাক্তার নিজের ক্লিনিকে কুড়াল দিয়েও সিজার করতে পারেন! একই চিত্র শিক্ষাঙ্গনেও— ক্লাসরুমে হাঁপিয়ে ওঠা শিক্ষক প্রাইভেট ব্যাচে ১২০ শিক্ষার্থী নিয়েও স্বচ্ছন্দ! অনেক শিক্ষক কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই ক্লাসে যান, নিয়ন্ত্রণকারীর ভয়ে গল্পগুজব করে ঘন্টা পার করেন। শিক্ষকতা, যে পেশা একসময় ছিল ব্রত— এখন অনেকের কাছে তা কেবল মাস কাটানোর উপায়। অথচ সেই ফাঁকিবাজ শিক্ষকও বেতন পেয়ে সন্তানের জন্য দুধ কেনেন, আর সুযোগ পেলেই শিক্ষার্থীদের নীতিকথা শোনান!
সম্প্রতি খবরে দেখলাম, শ’দেড়েক শিক্ষক জাল সনদ দিয়ে চাকরি নিয়েছেন এবং চিহ্নিত হওয়ার পরও রাষ্ট্র মানবিক কারণে তাদের মাফ করতে চায়! অতীতেও হাজারো জাল সনদধারী শিক্ষক চিহ্নিত হয়েছে, এবং অনুমান করি, আরও অনেক ভূয়া শিক্ষক আজও শিক্ষা নামের মহৎ কর্মে নিয়োজিত। রাষ্ট্র মানবিক হোক, কিন্তু যারা জালিয়াতি করে শিক্ষকতা পেশায় এসেছে— তাদের যেন ক্ষমা না করা হয়। রাষ্ট্র যেন নিজের পায়ে নিজে কুড়াল না মারে। একজন ভূয়া শিক্ষক তিরিশ বছর শিক্ষক পরিচয়ে থেকে হাজারো শিক্ষার্থীর সংস্পর্শে আসেন। এই পবিত্র অঙ্গনের মধ্যে কয়েকজন শিক্ষক নামের নষ্ট আত্মা গোটা সমাজকেই পচিয়ে দিতে যথেষ্ট।
যারা অবৈধ উপায়ে, ঘুষ-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি বা রাজনৈতিক আনুগত্যের মাধ্যমে শিক্ষক হয়েছেন— তাদের চিহ্নিত করতে রাষ্ট্রের একটি স্বতন্ত্র কমিশন গঠন করা জরুরি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এসব ভেজাল মানুষকে ছেঁকে, প্রয়োজনে তাদের অন্য পেশায় পাঠানো হোক। একটি প্রতিষ্ঠান নষ্ট করতে একজন নষ্ট মানসিকতার শিক্ষকই যথেষ্ট। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য— প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একাধিক “শিক্ষক নামের অশিক্ষক” রয়েছেন, যারা শিক্ষার জন্য কালসাপ। তাদের কারণে শিক্ষার্থীর মন ও শিক্ষার পরিবেশ ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে— রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এ নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার।
রাষ্ট্রের গোটা শিক্ষাব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে দুই স্তম্ভে— শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসক। একপক্ষের দুর্নীতি দুঃখজনক, কিন্তু যখন দুই দিকই পচে যায়, তখন সেই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখবে কে? এক পক্ষ যদি শুদ্ধ থাকে, তবে অন্য পক্ষ বাধ্য হয়েও শুদ্ধাচার বজায় রাখে। কিন্তু এখন ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’— এই প্রবাদটাই উল্টে গেছে। কে সাধু, আর কে মহাসাধু— তা বুঝতে বুঝতে রাষ্ট্রের দিন ফুরিয়ে আসে!
বাস্তবতা হলো— শিক্ষা এখন রাজনৈতিক পণ্য। শিক্ষানীতি পায় দলীয় মোড়ক, বিশ্ববিদ্যালয় পাঠে মিশে থাকে মতাদর্শের দাসত্ব। আর্থিক লেনদেনের ক্ষতি পূরণ করা যায়, কিন্তু চরিত্রের ঘাটতি কীভাবে পূরণ করবে, যদি তা হয় শিক্ষকদের? যিনি বলেছেন— “শিক্ষাব্যবস্থাই পচে গেছে”— তিনি মিথ্যা বলেনি। শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দিকে তাকালেই তার প্রমাণ মিলবে। বাকিটুকু আটকে আছে শিক্ষার মানে। তারপরেও মহাশয়ে উক্তির প্রতি প্রতিবাদ জানিয়ে শিক্ষকসমাজ আন্দোলনের ডাক দিতেও পারে!
সাহেব, জাতির মুক্তি কোথায়? আপনাদের কি কিছুই করার ছিল না? সবাই কেন ভুল পথেই হাঁটে?

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন