শায়খ সৈয়দ আনিসুল হক ||
"যদি আজই আমাদের জীবনের শেষ দিন হতো । হয়তো আগামীকাল। আমরা জানি- মৃত্যু একমাত্র নিশ্চিত বিষয়। এটি যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গায় আসতে পারে। কিন্তু আমরা কি সত্যিই এই সত্যের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত? যদি আমরা মৃত্যুর বাস্তবতাকে অন্তর ও মনে রাখতাম, তাহলে আমাদের জীবনযাপন কেমন হতো?
কথাগুলো বলেছেন ইস্ট লন্ডন মসিজদের সিনিয়র ইমাম শায়খ সৈয়দ আনিসুল হক। তিনি ২৪ অক্টোবর শুক্রবার ইস্ট লন্ডন মসজিদের মিম্বরে জুমার খুতবা উপস্থাপন করছিলেন।
তিনি বলেন, কয়েক দিন আগে, আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফোন করে দুঃখজনক খবর দিলেন — তার ভাতিজা, মাত্র ৩০ বছরের এক তরুণ, হঠাৎ ঘুমের মধ্যেই মারা গেছেন। কোনো অসুখ নয়, কোনো আগাম ইঙ্গিত নয়, কোনো বিদায়ও নয় । কাজ শেষে বাড়ি ফিরলেন, পরিবারের সাথে কিছু সময় কাটালেন, আর ফজরের সময় মা গিয়ে দেখলেন — তিনি আর জীবিত নন। সুবহানাল্লাহ।
তারও কয়েক সপ্তাহ আগে, আমাদের এলাকার আরো এক তরুণ ভাই ছুটিতে তুরস্কে গিয়ে ঘুমের মধ্যেই মারা গেলেন । এখন তার দুই সন্তান পিতৃহীন, স্ত্রী বিধবা।
এমন গল্পগুলো শুধু দুঃখের নয় । এগুলো আমাদের জাগিয়ে তোলার বার্তা। এগুলো আমাদের বাধ্য করে এক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে । তা হলো মৃত্যু।
রাসূল (সা:) বলেছেন, কিয়ামতের আগমনের লক্ষণগুলোর একটি হবে হঠাৎ মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি।
কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে হঠাৎ-মৃত্যু বৃদ্ধি পাবে। হঠাৎ মৃত্যু মানে- হাসপাতালের বিছানায় নয়, হয়তোবা শেষ কথা বলার সুযোগ নয়, শেষ দোয়া নয়, তাওবার সুযোগও নয় । শুধু… শেষ।
আসলে এই হঠাৎ মৃত্যু আমাদের অন্তরকে নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য, যেন আমরা ভাবতে পারি যদি আজই আমার শেষ দিন হতো?
যদি মৃত্যুর ফেরেশতা ইতিমধ্যেই আমার দিকে রওনা হয়ে থাকেন? যদি আজকের সূর্যোদয়ই আমার শেষ সূর্যোদয় হয়? তাহলে কি আমি সন্তানদের আরেকটু ভালোভাবে জড়িয়ে ধরতাম? নামাজে আরও মনোযোগী হতাম? ঝগড়া মিটিয়ে ফেলতাম? ক্ষমা চাইতাম? তাওবা করতাম? না কি আবারও বলতাম, “পরে বদলাবো…”?
সত্য কথা হলো — সেই দিন অবশ্যই আসবে । তুমি ভাবো বা না ভাবো, প্রস্তুতি নাও বা না নাও — এটি আসবেই।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: “প্রত্যেক প্রাণই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১৮৫)
প্রত্যেক প্রাণ ভালোবাসা, খ্যাতি বা সম্পদের স্বাদ নাও পেতে পারে— কিন্তু মৃত্যুর স্বাদ সবাই পাবে।
অনেকে ভুলভাবে ভাবেন, মৃত্যু মানেই শেষ, অনন্ত জীবনের সূচনা মাত্র। রাসূল (সা:) বলেছেন, “নিশ্চয়ই কবর হলো আখিরাতের প্রথম ধাপ । যদি কেউ এতে রক্ষা পায়, পরের ধাপগুলো সহজ হয়। আর যদি এতে ব্যর্থ হয়, পরের ধাপগুলো আরও কঠিন হয়। আমি কবরের চেয়ে ভয়ংকর কিছু দেখিনি।”
মৃত্যুর সাথে সাথে আমাদের পরীক্ষা শেষ। ফোন, টাকা, পদ-মর্যাদা সবকিছু হারিয়ে যাবে। আমাদের সাথে কবর পর্যন্ত যাবে শুধু আমাদের আমল।
আল্লাহ তায়ালা মৃত্যু মুহূর্তের বর্ণনা দিয়েছেন কুরআনে। তিনি বলেন, “যখন প্রাণ কণ্ঠে এসে পৌঁছে যায়, আর তখন তোমরা তাকিয়ে থাক, কিন্তু তখন আর কিছুই করতে পারো না। অথচ আমরা (আল্লাহ) তার চেয়েও নিকটে থাকি, কিন্তু তোমরা তা দেখো না।” (সূরা আল-ওয়াকিয়াহ, ৫৬:৮৩–৮৬)
রাসূল (সা:) বলেছেন, মৃত্যুর সময় ফেরেশতারা আত্মাকে ডেকে বলেন, “হে প্রশান্ত আত্মা, তোমার প্রভুর ক্ষমা ও সন্তুষ্টির দিকে বেরিয়ে এসো।” আর গুনাহগার আত্মার কাছে বলা হবে “হে অপবিত্র আত্মা! তোমার প্রভুর রোষ ও ক্রোধের দিকে বেরিয়ে এসো।”
তাহলে প্রশ্ন হলো, আমরা কোন দলের হবো? আমাদের পূর্বসূরিরা এই সত্য খুব ভালো বুঝতেন। ইবন কুদামাহ (রহ.) বলেন, কিছু নেক লোক নিজের কবর খুঁড়ে সেখানে শুয়ে পড়তেন এবং নিজেদের আত্মাকে বলতেন:
“হে আত্মা, তুমি মৃত। এখন তোমার কী ইচ্ছা?” আত্মা বলত: “পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে ভালো কাজ করতে চাই।”
তখন তারা বলত: “তোমার সেই সুযোগ এখনই আছে — উঠে ভালো কাজ করো।”
উসমান ইবন আফফান (রা:) বলেছিলেন, “হে আদম সন্তান! যে মৃত্যুর ফেরেশতা তোমার দায়িত্বে আছে, সে প্রতিদিন অন্যদের পাশ দিয়ে তোমার দিকেই এগিয়ে আসছে । তাই তার জন্য প্রস্তুত হও। তাকে ভুলে যেও না, কারণ সে তোমাকে ভোলেনি।”
রাসূল (সা:) বলেছেন, তুমি এই পৃথিবীতে এমনভাবে বসবাস করো, যেন তুমি একজন অপরিচিত বা পথচারী। একজন পথচারী রাস্তায় প্রাসাদ তৈরি করে না, আরামেও থাকে না- কারণ সে জানে, এটা তার স্থায়ী ঘর নয়।
কিন্তু আমরা এমনভাবে বাস করছি, যেন এই দুনিয়াই চিরকাল থাকবে।
কিন্তু মৃত্যু কোনো ধারণা নয়, এটি এক অবশ্যম্ভাবী বাস্তবতা । সবচেয়ে বড় প্রতারণা হলো, যেটা নিশ্চিত, সেটাকেই আমরা সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় মনে করি।
আল্লাহ তায়ালা সতর্ক করে বলেছেন, এই দুনিয়ার জীবন শুধুমাত্র খেলা ও বিনোদন ছাড়া কিছুই নয় । কিন্তু যারা আল্লাহকে ভয় করে, তাদের জন্য পরকালই উত্তম। তোমরা কি তা চিন্তা করবে না?”
(সূরা আল-আন’আম, ৬:৩২)।
তাই আমি সেই একই প্রশ্ন দিয়ে শেষ করছি যেটা দিয়ে শুরু করেছিলাম- যদি আজই তোমার শেষ দিন হতো?
আসুন, আমরা এখনই তাওবা করি । আমাদের অন্তর ঠিক করি । যা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ, তা কাল নয়, আজই করি।
আল্লাহ যেন আমাদের আত্মাকে তাঁর সন্তুষ্টি ও রহমতের মাধ্যমে গ্রহণ করেন, আমাদের সুন্দর পরিণতি দান করেন। আমাদেরকে উদাসীনতায় পতিত না করেন। এবং এমন জীবন দান করেন যা তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য আমাদের প্রস্তুত করে। আমিন।
জুমার খুতবা । ২৪ অক্টোবর ২০২৫।
শায়খ সৈয়দ আনিসুল হক : সিনিয়র ইমাম ও খতীব, ইস্ট লন্ডন মস্ক এন্ড লন্ডন মুসলিম সেন্টার।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন