শায়খ আবদুল কাইয়ুম ||
আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) এক গুরুত্বপূর্ণ হাদিসে বলেছেন, 'দোয়াই হলো ইবাদত'। অর্থাৎ দোয়া কেবল ইবাদতের একটি অংশ নয়, বরং ইবাদতের আসল রূপ । আল্লাহর সাথে আমাদের সম্পর্কের আসল সৌন্দর্য তখনই প্রকাশ পায়, যখন আমরা বিনয় আর ভালবাসা নিয়ে হাত তুলে তাঁর কাছে চাই । যখন আনন্দে, দুঃখে, ভয়ে কিংবা আশায় আমরা আল্লাহর কাছে ফিসফিস করে প্রার্থণা করি –তখনই বুঝবো যে আমরা আল্লাহর আসল বান্দা হিসেবে জীবনযাপন করছি।
আল্লাহ নিজেই কুরআনে বলেছেন: “তোমাদের প্রতিপালক বলেছেন- তোমরা আমাকে ডাকো, আমি সাড়া দেব । যারা আমার ইবাদত থেকে অহংকার করবে তারা অবশ্যই অপমানিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (সূরা গাফির, ৪০:৬০)
এই আয়াতে আল্লাহ দোয়াকে ইবাদতের সমান বলেছেন । দোয়া কোনো শেষ ভরসা নয়, বরং ঈমানের প্রকাশ । আমরা যদি দোয়া ছেড়ে দেই, তাহলে আমরা আসলে অহংকার করছি। নবী (সাঃ) সতর্ক করে বলেছেন: “যে আল্লাহর কাছে কিছুই চায় না, আল্লাহ তার ওপর রাগ করেন।” সুবহানাল্লাহ! কল্পনা করুন, আল্লাহ তখন রাগান্বিত হন যখন আমরা তাঁর কাছে চাই না – বেশি চাইলে নয়! কেন? কারণ আল্লাহ দাতা, আমরা ভিখারি। তিনি আর-রাজ্জাক (রিজিক দানকারী)। তিনি ছাড়া আমরা কিছুই নই । দোয়া আমাদের দুর্বলতা প্রকাশ করে এবং আল্লাহর শক্তি ঘোষণা করে। এটা সর্বশ্রেষ্ঠ বিনয়।
আর যখন কষ্ট আসে, তখন তাঁকেই তো ডাকতে হয়। আল্লাহ বলেন, আল্লাহ যদি তোমাকে কোনো কষ্টে ফেলেন, তাহলে তা দূর করার কেউ নেই তিনি ছাড়া। আর যদি তিনি তোমার জন্য কল্যাণ চান, তবে কেউ তা ঠেকাতে পারবে না। (সূরা ইউনুস, ১০:১০৭)।
তাহলে দেরি কেন? আমরা কেন অন্যের ওপর ভরসা করি, অথচ সবকিছু যাঁর হাতে তিনি তো আল্লাহ! নবী (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত বিষয় হলো দোয়া। এত সম্মানিত হওয়ার পরও অনেক মানুষ দোয়ার আদব ও শক্তি গুরুত্ব ভুলে যায়।
দোয়ার কিছু আদব বা শিষ্টাচার রয়েছে: ১. আল্লাহ তায়ালাকে তাঁর সুন্দর নাম ধরে ডাকতে হবে। তিনি বলেন, আল্লাহর জন্যই সব সুন্দর নাম, তাই তোমরা তাঁকে সেগুলো দিয়ে ডাক। (সূরা আ'রাফ, ৭:১৮০) তাই আমরা বলি, “ইয়া রহমান”, “ইয়া রহিম”, “ইয়া গাফফার”, “ইয়া রব্ব”—কারণ এগুলো আল্লাহর সুন্দর নাম । প্রতিটি নাম আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমাদের কতটা তাঁর রহমত ও ক্ষমার প্রয়োজন।
২. নবী (সাঃ) এর ওপর দরুদ পাঠ করা নবী (সাঃ) বলেছেন, দোয়া আকাশ আর জমিনের মাঝে থেমে থাকে । যতক্ষণ না নবীর ওপর দরুদ পাঠ করা হয়, তা আল্লাহর কাছে পৌছেনা। তাহলে দোয়া করার আগে বা পরে দরুদ অবশ্যই পড়তে হবে।
৩. ধৈর্য রাখা : অনেকে বলেন, “আমি অনেক দোয়া করেছি, কিন্তু কবুল হয়নি। আসলেই এটাই পরীক্ষা। নবী (সাঃ) বলেছেন, বান্দার দোয়া কবুল হতে থাকে যতক্ষণ না সে অধৈর্য হয়ে বলে, আমি দোয়া করেছি কিন্তু উত্তর পাইনি, তারপর সে দোয়া ছেড়ে দেয়।”
আসলে প্রতিটি দোয়া কবুল হয়, তবে তিনভাবে: ১. যা চাই তা পাওয়া যায় ।২. কোনো বিপদ দূর হয়ে যায়। ৩. অথবা আখিরাতে এর প্রতিদান জমা থাকা।
গোপনে দোয়া করার গুরুত্ব : অনেকে ভাবে হাজার মানুষ একসাথে দোয়া করলে সেটা বেশি শক্তিশালী। কিন্তু কুরআন ও সুন্নাহতে তা নেই। আল্লাহ বলেন, তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে বিনয় সহকারে ও গোপনে ডাকো। নিশ্চয়ই তিনি সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না। (সূরা আ'রাফ, ৭:৫৫)। জাকারিয়া আলাইহিস সালাম-এর দোয়া সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, যখন তিনি তাঁর রব্বকে গোপনে ডাকলেন। (সূরা মারইয়াম, ১৯:৩) আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন সেই দোয়া, যা গোপনে, চোখের জলে, সেজদায় করা হয়- যা কেউ দেখেনা, জানেনা। সুতরাং, আসুন আমরা দোয়া করার সাথে নতুন করে সম্পর্ক গড়ে তুলি । শুধু বিপদে নয়, প্রতিটি মুহুর্তে আল্লাহকে ডাকতে শিখি । মনে রাখুন, দোয়া শেষ সমাধান নয়, বরং প্রথম কাজ, প্রথম ভরসা, আসল ইবাদত।
শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫। শায়খ আব্দুল কাইয়ূম : ইস্ট লন্ডন মসজিদের প্রধান ইমাম ও খতীব।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন