ইস্ট লন্ডন মসজিদের জুমার খুতবা : অন্তরের গহীনে লুকিয়ে থাকা বর্ণবাদ

gbn

শায়খ আব্দুল কাইয়ুম ||

"আজকাল বর্ণবাদ সবসময় প্রকাশ্য নয়। এটি অনেক সময় আমাদের অন্তরে লুকিয়ে থাকে। আমরা কাকে সালাম করি, কাকে বাসায় দাওয়াত দিই, বা বিয়েতে কাকে পছন্দ করি বা করি না, এসবের মধ্যেই তার বহি:প্রকাশ ঘটে"।

কথাগুলো বলেছেন, ইস্ট লন্ডন মসজিদের প্রধান ইমাম ও খাতিব শায়খ আব্দুল কাইয়ূম। তিনি গত ১৭ অক্টোবর শুক্রবার ইস্ট লন্ডন মসজিদের জুমার খুতবা উপস্থাপন করছিলেন। তিনি বলেন- আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, “হে মানবজাতি! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো।” (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত ১৩)।

এই আয়াত শুধু একটি সুন্দর বাক্য নয়, বরং এটি মানবতার একটি সার্বজনীন নীতি। এটি বর্ণ, ভাষা, রং বা বংশের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের সমস্ত দাবি মুছে দেয়। আল্লাহ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন — আমরা সবাই আদম ও হাওয়া (আ.)-এর সন্তান; অর্থাৎ এক পরিবার।

রাসুলু (সা:) বলেছেন, “তোমরা সবাই আদমের সন্তান, আর আদম সৃষ্টি হয়েছেন মাটি থেকে ।” তাহলে গর্ব করার কী আছে? ইসলাম ঘোষণা দিয়েছে — কোনো জাতি, ভাষা বা দেশ অন্য জাতির চেয়ে উত্তম নয় । এই পার্থক্য শুধু পরিচয়ের জন্য, বিভেদের জন্য নয়।

রাসুল (সা:)-এর বিদায়-হজের ভাষণেও ছিলো একই বার্তা। তিনি বলেছেন “হে মানুষ, তোমাদের প্রভু একজন এবং পিতা একজন । কোনো আরব অ-আরবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়, অ-আরবও আরবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়, সাদা কালোর চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়, কালোও সাদার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয় — শ্রেষ্ঠত্ব কেবল তাকওয়া বা খোদা ভীতির মধ্যে ।” এই কয়েকটি কথার মাধ্যমে নবী (সা‍:) মানবজাতির সব কৃত্রিম বিভাজন ভেঙ্গে দিয়েছেন।

হযরত বিলাল (রা:) ছিলেন তাকওয়া ও ঈমানের প্রতীক। ইসলাম শুধু মুখে বর্ণবাদের নিন্দা করেনি, বরং এমন সমাজ গড়ে তুলেছে যেখানে মানুষের মূল্য নির্ধারণ হয়েছে চরিত্র ও ঈমানের ওপর। উদাহরণ হিসেবে শায়খ আব্দুল কাইয়ুম বলেন, হযরত বিলাল (রা:), একজন কৃষ্ণাঙ্গ দাস ছিলেন, যিনি ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন নির্বাচিত হন । নবী (সা:) তাঁকে এত ভালোবাসতেন যে মিরাজের রাতে তিনি জান্নাতে বিলাল (রা.)-এর পায়য়ে চলার আওয়াজ শুনেছিলেন।

এত মর্যাদা তিনি পেয়েছিলেন তাঁর নিয়মিত অজু ধরে রাখা ও প্রতিবার অজু শেষে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায়ের কারণে। আল্লাহ তাঁকে বংশ বা রঙে নয়, বরং ইবাদত ও আন্তরিকতায় উন্নত করেছেন।

আধুনিক সমাজে লুকিয়ে থাকা বর্ণবাদ: শায়খ আব্দুল কাইয়ূম বলেন, আজকাল বর্ণবাদ সবসময় প্রকাশ্য নয়। এটি অনেক সময় লুকিয়ে থাকে আমাদের আচরণে। কাকে সালাম করি, কাকে বাসায় দাওয়াত দিই, বা বিয়েতে কাকে পছন্দ করি বা করি না, এসবের মধ্যেই তার প্রকাশ ঘটে।

নবী (সা‍:) সতর্ক করে বলেছেন, “যে ব্যক্তি গোত্রভেদে দাওয়াত জানায়, গোত্রের জন্য যুদ্ধ করে, বা গোত্রের নামে মারা যায় — সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।”

আজকের বর্ণবাদ আসলে সেই প্রাচীন গোত্রবাদ (আসাবিয়্যাহ)-এর নতুন রূপ। আমরা কখনো কখনো নিজেদের অজান্তেই এমন ‘নরম’ বর্ণবাদে লিপ্ত হই, ধনী বা শিক্ষিতদের বেশি মর্যাদা দিই, অথচ মুত্তাকী মানুষদের উপেক্ষা করি।

আল্লাহ তাআলা বলেন “নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যে সবচেয়ে বেশি পরহেজগার।” (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত ১৩)। অর্থাৎ, মর্যাদার একমাত্র মাপকাঠি হলো তাকওয়া।

বিয়েতেও ইসলাম এই মানদণ্ড দিয়েছে । নবী (সা:) বলেছেন, “যদি এমন কোনো ব্যক্তি প্রস্তাব দেয় যার ধর্ম ও চরিত্র তোমাদের পছন্দ হয়, তাহলে তার সাথে বিয়ে দাও । যদি না দাও, তবে পৃথিবীতে বড় ফিতনা ও বিপর্যয় দেখা দেবে। তিনি বলেননি জাতি, বংশ বা অর্থ দেখো; বরং বলেছেন — দ্বীন ও চরিত্র দেখো।

শায়খ আব্দুল কাইয়ুম বলেন, আমরা যেন নিজেদের অন্তর পর্যালোচনা করি। আমাদের ভেতরে কোনো গোপন অহংকার বা জাতিগত বিভাজন রয়ে গেছে কি না । ইসলাম এসেছে ঐক্য স্থাপন করতে, বিভাজন নয়। বংশগৌরব নয়, বরং আল্লাহর দাসত্বে বিনয় শিখাতে।

তিনি একটি দোয়ার মাধ্যমে খুতবা সমাপ্ত করেন। “হে আল্লাহ, আমাদের অন্তর অহংকার ও বর্ণবাদ থেকে পরিশুদ্ধ করুন। আমাদের অন্তরকে তাকওয়ার আলোয় উজ্জ্বল করুন, মুখের রঙে নয়। আমাদের বিনয়ী জীবন দিন, মর্যাদাপূর্ণ মৃত্যু দিন এবং আমাদের উঠিয়ে নিন সেই দলভুক্ত করে যারা মানবতাকে সম্মান করেছে। আামিন।

শায়খ আব্দুল কাইয়ুম : ইস্ট লন্ডন মসজিদের প্রধান ইমাম ও খতীব

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন