শায়খ আবদুল কাইয়ূম ||
সন্তান প্রতিপালনে সবসময়ই চ্যালেঞ্জ রয়েছে, কিন্তু আজকের যুগে এই কাজটি আরও কঠিন হয়ে পড়েছে । আজকের বিশ্বে এমন সব চিন্তা-ভাবনা, সংস্কৃতি ও প্রভাব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, যা অনেক সময় ইসলামের শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত।
সন্তানকে মানুষ করাটা আজ শুধু ধৈর্যের কাজ নয়, বরং এটি এক বিরাট দায়িত্ব, যা আল্লাহর পথে অটল থাকার মাধ্যমেই পূর্ণ হতে পারে।
আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনে আমাদের এই দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই আগুন থেকে রক্ষা করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। (সূরা তাহরিম, ৬) এই আয়াত শুধু একটি উপদেশ নয়, বরং এটি আমাদের জন্য একটি বিশেষ বার্তা। এর মানে হলো—সন্তান মানুষ করাটা শুধু দুনিয়ার জন্য নয়, বরং আখিরাতের জন্য প্রস্তুত করার দায়িত্ব। আমরা সন্তানদের যেভাবে গড়ে তুলছি, যেসব অভ্যাস শেখাচ্ছি, যেভাবে কথা বলছি—এই সবই তাদের ভবিষ্যৎ গন্তব্য নির্ধারণ করছে।
রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, তোমাদের প্রত্যেকেই একেকজন রাখাল, এবং প্রত্যেকেই তাঁর দায়িত্বের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে।' (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
অর্থাৎ, প্রত্যেক বাবা-মা ও অভিভাবক তার পরিবারকে কীভাবে পরিচালনা করেছে, সে বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে। আমরা কি সন্তানদের হালাল-হারামের পার্থক্য শিখিয়েছি? পর্দা, নম্রতা, লজ্জাশীলতা (হায়া) এবং ঈমানের শিক্ষা দিয়েছি? নাকি এই দায়িত্ব আমরা ইন্টারনেট, মিডিয়া আর স্কুলের পাঠ্যক্রমের হাতে তুলে দিয়েছি?
আজকাল একটি বড় চিন্তার বিষয় হলো—স্কুলে যৌন শিক্ষার নামে এমন বিষয় পড়ানো হচ্ছে, যেখানে লিঙ্গ পরিচয় ও যৌনতা নিয়ে এমন ধারণা দেওয়া হচ্ছে যা ইসলামের শিক্ষা থেকে অনেকটাই ভিন্ন।
কিছু বিষয় যেমন, সদাচরণ ও নিরাপত্তার কথা শুনতে ভালো লাগলেও, অনেক কিছুই রয়েছে যা আমাদের ইসলামী মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক।
আমরা পরিষ্কার করে বলি ইসলাম শিক্ষাবিরোধী নয়। আমাদের ধর্মে জ্ঞান অর্জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই জ্ঞান সত্যভিত্তিক হতে হবে। যখন শিক্ষা সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য ঘোলা করে ফেলে, তখন আমাদের এগিয়ে আসা জরুরি।
তাহলে, আমরা কী করবো? ১. আপনার সন্তান কী শিখছে সেটা জানুন। তার গতিবিধি সম্পর্কে শুধু ধারণা করে বসে থাকবেন না। স্কুলে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন। মিটিংয়ে অংশ নিন । সিলেবাস দেখুন। না জানলে আপনি কিছু করতে পারবেন না।
২. আপনার অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকুন। আইনের দৃষ্টিতে, যৌন শিক্ষা সম্পর্কে আপনার জানার অধিকার আছে। আপনি চাইলে কোনো নির্দিষ্ট ক্লাস থেকে সন্তানকে বাদ দেওয়ার অধিকার রাখেন । সবসময় স্কুল থেকে আপনাকে জানানো হবেনা। আপনাকে নিজে জানতে হবে এবং সম্মানের সাথে কিন্তু দৃঢ়ভাবে কথা বলতে হবে।
৩. কমিউনিটিকে ঐক্যবদ্ধ করুন : একা একা কথা বললে গুরুত্ব না-ও পেতে পারেন। কিন্তু সবাই মিলে বললে, স্কুল গুরুত্ব দিতে বাধ্য হবে। অভিভাবকদের সাথে এক হয়ে, সভায় যান, সম্মিলিতভাবে দাবী তুলুন।
৪. নিজের ঘরকে শক্তিশালী করুন : শিক্ষা অর্জনে স্কুলের একটা প্রভাব আছে, কিন্তু ঘর সবচেয়ে বড় প্রভাব। ঘরে কুরআন-হাদীস শেখান। সন্তানদের সাথে খোলামেলা সম্পর্ক গড়ে তুলুন যেন তারা প্রশ্ন নিয়ে আপনার কাছেই আসে, ইন্টারনেট বা টিকটকে নয়। ঘরে ইসলামকে সুন্দরভাবে তুলে ধরুন । আল্লাহ তায়ালার কথা বলুন। রাসূলুল্লাহ (সা:) কে পরিচিত করান। ইসলামকে বোঝান—এটা কোনো বোঝা নয়, বরং আলোর পথ। তাদের শেখান-সত্য মানে যা জনপ্রিয় তা নয়, বরং যা আল্লাহ বলেছেন, সেটাই সত্য।
সন্তানরা বড় হবে, অনেক চিন্তার মুখোমুখি হবে। কিন্তু যদি তাদের ঈমান মজবুত হয়, বিশ্বাস থাকে কেন ইসলামকে মানতে হবে—তাহলে তারা বিপদে পড়েও ঠিক থাকবে, ইনশাআল্লাহ।
যেমনটি হযরত ইবরাহিম (আ:) দোয়া করেছিলেন: “হে আমার রব! আমাকে ও আমার বংশধরের কিছু অংশকে নামাজ আদায়ের সহি রাখুন । হে আমাদের রব! আমার এই দোয়া কবুল করুন।” (সূরা ইবরাহিম, ৪০)
আমরা দোয়ার শক্তিকে ভুলে যাই না। আমাদের প্রচেষ্টা যেমন জরুরি, তেমনি সব সময় আল্লাহর কাছে মুনাজাত করতে হবে যেন তিনি আমাদের সন্তানদের হেফাজত করেন, হিদায়াত দেন, তাদের ঈমান শক্তিশালী করেন।
আজকের চ্যালেঞ্জ অনেক। কিন্তু আমাদের ইসলাম চিরন্তন। এই দ্বীন আমাদের এমন শক্তি দেয়, যাতে আমরা সব পরীক্ষায় টিকে যেতে পারি।
আমরা সন্তানদের কেবল লুকিয়ে রক্ষা করবো না, বরং এমন জ্ঞান, ঈমান ও আত্মবিশ্বাস দেবে-যাতে তারা সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বুঝে, হালালকে ভালোবাসে, আর হারাম থেকে দূরে থাকে।
আল্লাহ আমাদের সন্তানদের হেদায়াত দিন, ঈমান শক্তিশালী করুন, তাদের অন্তর রক্ষা করুন, এবং দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের নেককার বানান। আমিন।
শায়খ আবদুল কাইয়ূম : ইস্ট লন্ডন মসজিদের প্রধান ইমাম ও খতীব জুমার খুতবা : শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন