ইস্ট লন্ডন মসজিদের জুমার খুতবা : অন্তর কীভাবে ঠিক করা যায়

gbn

শায়খ মুস্তাফা আবদুল্লাহ ||

আজ আমরা যখন পৃথিবীর দিকে তাকাই, দেখি দারিদ্র্য, অবিচার আর যুদ্ধ বেড়ে চলেছে । তা আমাদেরকে হতাশ করতে পারে । কিন্তু মানবজাতি এর আগে কখনো কষ্টের মুখোমুখি হয়নি, তা নয় । প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাঃ) প্রেরিত হওয়ার আগে পৃথিবী অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল।

আরব দেশে, সম্পদ ছিল কেবল অল্প কয়েকজনের হাতে, আর বাকিরা কষ্টে দিন কাটাতো । ধনীরা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত। নারী ও শিশুদের কোনো অধিকার ছিল না। লোকে কন্যা সন্তানদের লজ্জা আর ভয় থেকে মাটিতে পুঁতে ফেলত। অনেক পরিবার বেঁচে থাকার জন্য সন্তানদের দাসত্বে বিক্রি করে দিত। কেউ কেউ সন্তানই চাইত না, কারণ তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে পারবে না বলে ভয়ে থাকত।

আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনে বলেন: “দারিদ্র্যের ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না। আমরাই তাদেরকে রিযিক দিই এবং তোমাদেরকেও।” এই পৃথিবীতেই আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে (সাঃ) পাঠালেন। আল্লাহ তাঁকে অন্ধকারের মাঝে আলো হিসেবে নির্বাচিত করলেন। তিনি তাঁর প্রিয় নবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমরা তোমাকে  বিশ্ববাসীর জন্য রহমত ব্যতীত অন্য কিছুর জন্য পাঠইনি।” (কুরআন, ২১:১০৭) তিনি শুধু দয়ার কথা বলেননি, আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) নিজেই তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন।

নবী (সাঃ) পবিত্র ও সম্মানিত বংশধারা থেকে আগমন করেছেন । তাঁর কোনো পূর্বপুরুষ অনৈতিক কাজে জড়িত ছিলেন না। এমনকি তাঁর শত্রুরাও তাকে “মর্যাদাশালী ভাই, মর্যাদাশালী ব্যক্তির সন্তান” বলে ডাকত । ইসলামের পূর্বেও তাঁর সততা ও বিশ্বস্ততার সুনাম সুপরিচিত ছিল।

কিন্তু তাঁর বংশের চেয়েও বড় বিষয় হলো—তিনি কী নিয়ে এসেছিলেন। নবী (সাঃ) দরিদ্র, নিপীড়িত ও উপেক্ষিতদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। তিনি বলেছেন: “তোমাদের মধ্যে সেরা সে-ই, যে দরিদ্র ও অভাবীদের সাথে উত্তম ব্যবহার করে।” (মুসনাদ আহমদ)। তিনি শুধু দুর্বলদের সুরক্ষা দেননি, শক্তিশালীদেরও পথ দেখিয়েছেন। তিনি ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছেন। রাসুল (সাঃ) বলেছেন: “তোমার ভাইকে সাহায্য করো, সে যদি নির্যাতিত হয় কিংবা সে যদি নির্যাতনকারীও হয়।” সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, “নির্যাতনকারী হলে কিভাবে সাহায্য করব?” তিনি উত্তর দিলেন:“তাকে নির্যাতন থেকে বিরত রেখে।” (বুখারি, মুসলিম) এমনকি ক্ষুদ্রতম কাজেও তিনি আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন: “যদি কেয়ামত এসে যায়, আর তোমাদের কারও হাতে একটি চারা থাকে, তবে সে যেন সেটি রোপণ করে।” (মুসনাদ আহমদ)। তিনি দয়ার বার্তা নিয়ে এসেছেন। আর কঠিন সময়ে তিনি নিজেই সেই বার্তা জীবন্ত করে তুলেছেন। তিনি বয়কট হওয়া, ক্ষুধা, প্রিয়জন হারানো এবং গভীর দুঃখের মুখোমুখি হয়েছেন। তবুও তিনি দৃঢ় থেকেছেন। মদিনায় হিজরত করার পর প্রথমেই তিনি সমাজের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধান করেন। তিনি দরিদ্রদের সাহায্য করেন, ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলেন, এবং মানুষকে শিখিয়েছেন অর্ধেক রুটিও ভাগাভাগি করতে। আজ আমরা আবার একই ধরনের পৃথিবীর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ক্ষমতাবানরা দুর্বলদের শোষণ করছে। হৃদয় কঠিন হয়ে গেছে। সম্পদের পূজা করা হচ্ছে। মানুষ জানে না কোথায় ফিরে যাবে। এমনকি নির্মল হৃদয়ের লোকেরাও পথ হারিয়ে ফেলেছে। তাই আজ নবী (সাঃ) এর বার্তা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি শিখিয়েছেন, মানুষের অন্তরই সবকিছুর মূল। তিনি (সাঃ) বলেছেন: “মানবদেহে একটি অঙ্গ আছে, তা ভালো হলে পুরো দেহ ভালো হয়, আর তা নষ্ট হলে পুরো দেহ নষ্ট হয়। নিশ্চয়ই, তা হলো হৃদয়।” সুস্থ অন্তর মানে শুধু নামাজ বা রোজা নয়। বরং প্রশান্তি, আস্থা আর মনোযোগ। আমরা অনেকেই নামাজে দাঁড়াই, অথচ মন থাকে ব্যবসা, সন্তান কিংবা দুশ্চিন্তায়। আমরা জানি এর অনুভূতি কেমন। তাহলে অন্তর কীভাবে ঠিক করা যায়? নবী (সাঃ) সহজ উত্তর দিয়েছেন: “তুমি যেখানে থাকো আল্লাহকে ভয় করো। আর কোনো খারাপ কাজ করলে তার পরে ভালো কাজ করো – তা খারাপ কাজকে মুছে দেবে।” এই হাদিস আসলে পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন। আল্লাহকে ভয় করলে পরিষ্কার বোঝা যায় কী সঠিক আর কী ভুল। আর যদি ভুল করো, তবে হাল ছেড়ো না—তারপরই ভালো কাজ করো। আল্লাহ বলেন: “যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য উত্তরণের পথ বানিয়ে দেন। আর যে আল্লাহর উপর ভরসা করে, আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট।” (কুরআন, ৬৫:২–৩)। তাহলে তুমি যদি বিবাহ, অর্থ, সন্তান বা ভবিষ্যৎ নিয়ে কষ্টে থাকো—আল্লাহকে ভয় করো। তাঁর উপর ভরসা করো। আর এগিয়ে চলো। কিন্তু আমরা কীভাবে নবী (সাঃ) কে ভালোবাসা দেখাবো? আল্লাহ স্পষ্ট করে বলেছেন: “বলুন: যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তবে আমাকে অনুসরণ করো; আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপ ক্ষমা করবেন।” (কুরআন, ৩:৩১) আর নবী (সাঃ) বলেছেন: “তোমাদের কেউ সত্যিকার ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা, তার সন্তান, এবং সমগ্র মানবজাতির চেয়ে বেশি প্রিয় হয়ে উঠি।” (বুখারি, মুসলিম)

সত্যিকারের ভালোবাসা মানে তাঁর সুন্নাহ অনুসরণ করা। দয়ার সাথে বাঁচা। ন্যায়ের সাথে কথা বলা। কঠিন সময়েও কল্যাণের বীজ বপন করা। আর শান্তি ছড়িয়ে দেওয়া, যেমন তিনি শিখিয়েছেন: “তোমরা নিজেদের মধ্যে সালাম ছড়িয়ে দাও।” (মুসলিম) তিনি আমাদের দেখিয়েছেন কিভাবে লক্ষ্য, ধৈর্য আর ভালোবাসা নিয়ে বাঁচতে হয়—এমনকি যখন পৃথিবী ছিল নিষ্ঠুর। আর তিনি রেখে গেছেন দুটি জিনিস আমাদের পথনির্দেশনার জন্য: “আল্লাহর কিতাব এবং আমার সুন্নাহ।” আমরা যদি এগুলো আঁকড়ে ধরি, কখনো পথ হারাবো না।

আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করি: হে আল্লাহ, আমাদের অন্তরকে আপনার প্রিয় নবীর ভালোবাসায় পূর্ণ করুন। হে আল্লাহ, আমাদেরকে তাঁর সুন্নাহর পথে চলার তাওফিক দিন, তাঁর দয়ার সাথে বাঁচার তাওফিক দিন, এবং তাঁর পথে মৃত্যুবরণ করার তাওফিক দিন। হে আল্লাহ, আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা দৃঢ়ভাবে তাঁর শিক্ষার সাথে অটল থাকে।কিয়ামতের দিনে আমাদেরকে তাঁর সঙ্গ দান করুন। আর আমাদেরকে তাঁর হাতে একবার পান করান, যারপর আমরা আর কখনো তৃষ্ণার্ত হবো না।

ইস্ট লন্ডন মসজিদের জুমার খুতবা, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫। শায়খ মুস্তাফা আবদুল্লাহ : অতিথি খতীব।

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন