ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স ও আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি

gbn
হুসনা খান হাসি || মানুষের মন এক বিস্ময়কর গোলকধাঁধা। সেখানে আলো-অন্ধকারের মিশ্রণ, যেখানে একদিকে থাকে আত্মবিশ্বাস, সৃজনশীলতা, ভালোবাসা, আর অন্যদিকে লুকিয়ে থাকে ভয়, সন্দেহ, আর নিজেকে ছোট মনে করার প্রবণতা। এই অন্ধকার দিকের অন্যতম একটি রূপ হলো ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স বা হীনমন্যতা, যা একজন মানুষকে ধীরে ধীরে নিজের মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। হীনমন্যতা এমন এক মানসিক অবস্থা, যেখানে মানুষ ক্রমাগত ভাবে যে সে অন্যদের চেয়ে কম সক্ষম, কম বুদ্ধিমান, কম আকর্ষণীয় বা কম যোগ্য। এই ধারণা শুধু চিন্তার জগতে সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি আচরণে প্রভাব ফেলে। কেউ হয়তো অন্যদের সামনে কথা বলতে দ্বিধা বোধ করে, কেউ নিজের কাজকে কখনো যথেষ্ট মনে করে না। এই মানসিক জটিলতার শিকড় সাধারণত শৈশবেই রোপিত হয়। যখন কোনো শিশু বারবার শুনতে পায় যে সে যথেষ্ট ভালো নয়, অথবা তাকে অন্য কারও সঙ্গে তুলনা করা হয়, তখন তার অবচেতন মনে জন্ম নেয় এক গভীর সন্দেহ, “আমি কি সত্যিই অযোগ্য?” এই সন্দেহ পরিণত বয়সে এসে আত্মবিশ্বাসকে ক্ষয় করে দেয়। সমাজও অনেক সময় এই হীনমন্যতাকে আরও গভীর করে তোলে। আমরা এমন এক পরিবেশে বাস করি যেখানে তুলনা যেন জীবনের স্বাভাবিক নিয়ম। কারো চাকরি, কারো গাড়ি, কারো চেহারা–সবকিছুর সাথে নিজেদের মাপার প্রবণতা আমাদের মনে অবিরাম অসম্পূর্ণতার অনুভূতি জাগায়। সামাজিক মাধ্যম এই তুলনাটিকে আরও তীব্র করে তোলে, যেখানে সবাই নিজের সেরা দিকটাই প্রকাশ করে, অথচ অন্যের সেই নিখুঁত ছবির পেছনের সংগ্রামটা চোখে পড়ে না। যখন হীনমন্যতা মনের গভীরে জায়গা করে নেয়, তখন আত্মবিশ্বাস ক্রমশ নিঃশেষ হয়ে যায়। মানুষ নিজের যোগ্যতার উপর বিশ্বাস রাখতে পারে না। কোনো কাজে সফল হলেও সে ভাবে, “এটা কাকতালীয়,” অথবা “আমি সত্যিই এটা প্রাপ্য নই।” এই মানসিকতা ধীরে ধীরে আত্মসম্মানকে ক্ষয় করে এবং জীবনের আনন্দকেও গ্রাস করে। আত্মবিশ্বাসের অভাব শুধু মানসিক নয়, শারীরিক প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি করে। ব্যক্তি নিজের উপস্থিতি লুকিয়ে রাখতে চায়, চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে না, সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে, এমনকি নিজের অনুভূতিও প্রকাশ করতে দ্বিধা বোধ করে। ক্রমে সে এক নীরবতার মধ্যে হারিয়ে যায়, যেখানে শব্দ আছে, কিন্তু নিজের কণ্ঠ নেই। তবুও, হীনমন্যতা কোনো অমোঘ নিয়তি নয়। এটি এমন এক মানসিক অবস্থা যা বোঝা, চেনা এবং পরিবর্তন করা সম্ভব। প্রথম পদক্ষেপ হলো নিজের ভেতরের কণ্ঠকে শোনা, যে কণ্ঠ বলে “আমি পারি না”, তাকে জিজ্ঞেস করা “কেন পারব না?” নিজের চিন্তার ধরণকে চ্যালেঞ্জ করাই মুক্তির শুরু। এরপর দরকার নিজের অতীত অভিজ্ঞতাগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়া তৈরি করা। হয়তো কোনো ব্যর্থতা, কোনো প্রত্যাখ্যান বা কোনো অপমান আজও মনে গেঁথে আছে। কিন্তু মানুষ সেই ঘটনার চেয়ে বড়। অতীতের ক্ষত স্বীকার করলেও তা যেন বর্তমানের সীমা না নির্ধারণ করে, এই উপলব্ধিই আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার পথ খুলে দেয়। নিজেকে ভালোবাসা ও গ্রহণ করা হীনমন্যতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। নিজের সাফল্য যত ছোটই হোক না কেন, সেটি উদযাপন করা দরকার। যেমন, কেউ হয়তো একদিন সাহস করে কোনো মিটিংয়ে কথা বলেছে, সেটিও এক অর্জন। আত্মবিশ্বাস বাড়ে ধীরে ধীরে, প্রতিটি ছোট সাফল্যের সঙ্গে। সঠিক মানুষদের সান্নিধ্যও এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এমন বন্ধু বা সহকর্মী যারা উৎসাহ দেয়, সমালোচনা নয়, তাদের উপস্থিতি আত্মবিশ্বাসকে দৃঢ় করে। বিপরীতে, নেতিবাচক সম্পর্ক বা সবসময় তুলনামূলক আচরণ করা মানুষদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা প্রয়োজন। আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে আত্মসচেতনতার ভিতের উপর। নিজের সীমাবদ্ধতা জানা যেমন জরুরি, তেমনি নিজের শক্তি চেনাও গুরুত্বপূর্ণ। আত্মবিশ্বাস মানে অহংকার নয়, বরং শান্ত এক বিশ্বাস, যা মানুষকে ব্যর্থতার মধ্যেও টিকিয়ে রাখে, আবার নতুন করে চেষ্টা করার সাহস দেয়। যে মুহূর্তে মানুষ নিজের মূল্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়, সেই মুহূর্তেই ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স তার শক্তি হারাতে শুরু করে। তখন আর বাইরের প্রশংসা বা তুলনা তার মনকে দোলায় না। সে জানে, নিজের ভিতরের স্থিরতা বাইরের সব শব্দের চেয়ে গভীর। শেষমেশ বলা যায়, ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স ও আত্মবিশ্বাসের অভাব আসলে আত্মপরিচয়ের বিকৃতি। নিজের অস্তিত্বকে বোঝা, ভালোবাসা, এবং নিজের ভুলগুলোকে সহনীয় চোখে দেখা, এই তিনটি অভ্যাসই মানুষকে মুক্ত করে। যে নিজেকে শ্রদ্ধা করতে শেখে, তার চোখে পৃথিবীও ধীরে ধীরে সুন্দর হয়ে ওঠে। আত্মবিশ্বাস তখন আর বাহ্যিক কোনো গুণ নয়, বরং এক অন্তরের আলোক, যা মানুষকে সাহস, মর্যাদা, এবং শান্তিতে বাঁচতে শেখায়। gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন