হুসনা খান হাসি ||
যুক্তরাজ্যের শহরে রাস্তায় হাঁটলে মানুষের গল্প চোখে পড়ে। পার্কের বেঞ্চে বসে থাকা বৃদ্ধা, ব্যস্ত সাইকেল আরোহী, কিংবা শহরের লাইব্রেরির নিঃশব্দ কোণে অধ্যয়নরত তরুণ-তরুণী, প্রতিটি মানুষই নিজের জীবন সংগ্রামের এক অনন্য গল্প বহন করে। এই ভিড়ে সবচেয়ে শক্তিশালী গল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশি একক অভিভাবকদের কাহিনী। তারা, যারা একা থাকলেও কখনও হাল ছাড়েননি, সমাজের আড়চোখ চোখ এবং অপ্রয়োজনীয় সমালোচনার মুখোমুখি হয়েও নিজেদের সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করেছেন।
কলঙ্ক বলতে আমরা প্রায়শই যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি বোঝাই, তা প্রায়শই মনস্তাত্ত্বিক চাপের সঙ্গে মিলেমিশে যায়। একক মাতৃত্ব বা পিতৃত্বকে অনেক সময় সমাজ আড় চোখে দেখে। কিন্তু এই অভিজ্ঞতাই অভিভাবকদের দৃঢ়তা এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা গড়ে তোলে। প্রতিটি রাতের অতিরিক্ত পরিশ্রম, প্রতিটি শিক্ষার সুযোগের জন্য সংগ্রাম, প্রতিটি স্বপ্নের ক্ষুদ্র স্থগিত, এসব তাদের মনোবল, ধৈর্য্য এবং প্রতিকূলতার সঙ্গে মোকাবেলার ক্ষমতাকে জোরদার করে।
যুক্তরাজ্যের এই অভিভাবকরা জানেন কিভাবে তাদের সন্তানদের জন্য নিরাপদ, শিক্ষামূলক এবং সমৃদ্ধ জীবন তৈরি করতে হয়। তারা শুধুমাত্র আর্থিক ও শিক্ষাগত দিক দিয়ে নয়, সামাজিক ও মানসিক দিক থেকেও নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করছেন। তাদের দৈনন্দিন জীবন অনেক সময় কঠোর বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই, যেখানে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা, কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জ এবং সামাজিক প্রত্যাশা সবই একত্রিত হয়ে যায়। কিন্তু প্রতিটি চ্যালেঞ্জ তাদের অভিজ্ঞতা এবং প্রজ্ঞাকে আরও সমৃদ্ধ করে।
কলঙ্ককে শক্তিতে রূপান্তরিত করার প্রথম ধাপ হলো আত্মসম্মান। সমাজ যাই বলুক না কেন, নিজের সিদ্ধান্তে দৃঢ় থাকা, নিজের এবং সন্তানের মর্যাদা রক্ষা করা, এবং জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখা, এই শক্তি একটি স্থিতিশীল ভিত্তি গঠন করে। এটি অভিভাবকদের মানসিক স্বাধীনতা এবং নিজের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে।
দ্বিতীয় ধাপ হলো কমিউনিটির সহায়তা গ্রহণ। যুক্তরাজ্যের শহরগুলোতে কমিউনিটি সেন্টার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশি একক অভিভাবকরা মানসিক এবং প্রাত্যহিক সহায়তা পান। তারা এই স্থানগুলোকে ব্যবহার করে শিক্ষা, পরামর্শ, এবং নতুন সুযোগ অর্জন করেন। কমিউনিটির এই সহায়তা তাদেরকে অনুভব করায় যে তারা একা নয়, এবং একসাথে এগিয়ে চলার শক্তি তৈরি হয়।
শিক্ষা এবং পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তারা শুধুমাত্র নিজেদের জীবনের মান উন্নত করছেন না; তারা সন্তানদের জন্যও উদাহরণ স্থাপন করছেন। সন্তানরা এই সংগ্রাম থেকে শিখে যে কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য্য এবং সংকল্প জীবনের বাস্তব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার শক্তি দেয়। একক অভিভাবকদের এই দৃষ্টিভঙ্গি সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য আত্মবিশ্বাস ও অনুপ্রেরণার এক শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে।
অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনও তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তারা জানেন কিভাবে বাজেট পরিচালনা করতে হয়, ঋণ সামলাতে হয়, এবং একটি স্থায়ী ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করতে হয়। এই আর্থিক দায়িত্বের সঙ্গে মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা তাদের জন্য কোনো সহজ কাজ নয়। কিন্তু প্রতিটি সাফল্য, প্রতিটি ছোট অগ্রগতি তাদের আত্মবিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করে।
সমাজের চোখে “ভিন্ন” হিসেবে চিহ্নিত হওয়া কখনও কখনও চাপ সৃষ্টি করে। তবুও এই অভিভাবকরা প্রমাণ করেছেন যে ভিন্ন হওয়া কখনো দুর্বলতা নয়; বরং এটি একটি শক্তি। তারা শিখিয়েছেন কিভাবে নিজের পরিচয়কে মর্যাদা দিয়ে এগিয়ে চলা যায়, এবং কীভাবে সমাজের কলঙ্ককে শক্তিতে রূপান্তরিত করা যায়।
এই অভিভাবকরা শুধু ব্যক্তিগত সাফল্য অর্জন করছেন না; তারা এক নতুন প্রজন্মের জন্য উদাহরণ স্থাপন করছেন। প্রতিটি সংগ্রাম, প্রতিটি আত্মত্যাগ এবং প্রতিটি অর্জিত লক্ষ্য একটি শক্তির প্রতীক। তারা দেখিয়েছেন যে সঠিক মনোভাব, অধ্যবসায় এবং সমর্থনের মাধ্যমে যে কোনও প্রতিকূলতা উত্তরণের সুযোগ হয়ে দাঁড়ায়।
সমষ্টিগতভাবে, যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশী একক অভিভাবকরা প্রমাণ করছেন যে কলঙ্ক কখনো চূড়ান্ত নয়। এটি হতে পারে শেখার সুযোগ, শক্তি অর্জনের উপায়, এবং নতুন সম্ভাবনার সূচনা। তাদের গল্প আমাদের দেখায় যে জীবনকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া সম্ভব, প্রতিকূলতা মোকাবেলা করা সম্ভব, এবং ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বলভাবে গড়ে তোলা সম্ভব।
অবশেষে, কলঙ্ককে শক্তিতে রূপান্তরিত করা কেবল একটি ব্যক্তিগত অর্জন নয়, এটি সমাজের জন্য একটি দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশী একক অভিভাবকরা প্রমাণ করেন যে সাহস, ধৈর্য, এবং সৃজনশীলতা দিয়ে সন্তান প্রতিপালন সম্ভব এবং মর্যাদার সাথে করা যায়। তাদের সংগ্রাম এবং সফলতা আমাদের শেখায় যে সামাজিক বাধা কখনও চূড়ান্ত নয়; বরং এটি অনুপ্রেরণা, শক্তি, এবং নতুন সম্ভাবনার পথ খুলে দেয়।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন