হুসনা খান হাসি ||
প্রাণী পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের অপরিহার্য অংশ। মানুষ যেমন প্রকৃতির সন্তান, তেমনি প্রাণীরাও এই পৃথিবীর সমান অধিকারী। অথচ সভ্যতার বিকাশের নামে মানুষ প্রাণীদের প্রতি অবহেলা, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে যুগের পর যুগ। এই বাস্তবতায় প্রতি বছর ৪ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব প্রাণী দিবস। দিনটি মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় প্রাণীর প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন ও তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সচেতন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা।
বিশ্ব প্রাণী দিবসের সূচনা হয়েছিল ১৯২৫ সালে জার্মান লেখক হেইনরিশ জিমারম্যান-এর উদ্যোগে। পরে ১৯৩১ সালে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক পরিবেশ সম্মেলনে দিবসটিকে বৈশ্বিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ৪ অক্টোবর তারিখটি বেছে নেওয়া হয় কারণ এ দিনটি সেন্ট ফ্রান্সিস অব আসিসি-এর মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি ছিলেন প্রাণী ও প্রকৃতির প্রতি অসীম মমতার প্রতীক। তার জীবনদর্শন থেকেই দিবসটির মানবিক ভিত্তি গড়ে ওঠে।
এই দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো:
• প্রাণীর অধিকার ও কল্যাণ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করা।
• প্রাণী নির্যাতন ও অবৈধ বাণিজ্য রোধে সবার ভূমিকা নিশ্চিত করা।
• বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের গুরুত্ব তুলে ধরা।
• মানুষকে প্রাণীর সঙ্গে সহাবস্থানের শিক্ষা দেওয়া।
প্রাণী শুধু মানুষের সঙ্গী নয়, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য অপরিহার্য।
• মৌমাছি ফুলে পরাগায়ন করে কৃষিজ উৎপাদন টিকিয়ে রাখে।
• বাঘ, সিংহের মতো শিকারি প্রাণী খাদ্যশৃঙ্খল সঠিক রাখে।
• পাখি ও কীটপতঙ্গ বীজ ছড়িয়ে বনভূমি রক্ষা করে।
• এমনকি সমুদ্রের তিমি ও ডলফিন সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ প্রাণী প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। বন উজাড়, জলবায়ু পরিবর্তন, দুষণ ও অবৈধ শিকার এ বিপদের প্রধান কারণ।
মানুষের আসল শক্তি আধিপত্যে নয়, সহমর্মিতায়। একটি কুকুরকে আশ্রয় দেওয়া, একটি পাখির জন্য জল রাখা বা প্রাণী নির্যাতনের প্রতিবাদ করা মানবতার প্রকৃত পরিচয়। ছোট ছোট কাজের মাধ্যমেই বড় পরিবর্তন সম্ভব।
বিশ্ব প্রাণী দিবস উপলক্ষে অনেক দেশে প্রাণী আশ্রয়কেন্দ্রে খাদ্য ও চিকিৎসা দেওয়া হয়, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে প্রচারাভিযান চালানো হয়, এমনকি স্কুল-কলেজে সচেতনতা কর্মসূচি আয়োজন করা হয়।
বাংলাদেশে প্রাণী সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ কার্যকর রয়েছে। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, ইরাবতি ডলফিন, বিভিন্ন পরিযায়ী পাখি এবং স্থানীয় বন্যপ্রাণী রক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন প্রাণী কল্যাণ সংগঠনও কাজ করছে কুকুর-বিড়ালের মতো অবহেলিত প্রাণীর চিকিৎসা ও আশ্রয়ের জন্য।
প্রাণী সংরক্ষণের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মানুষের লোভ ও অসচেতনতা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে বন উজাড় ও শিকার চলতে থাকলে কোনো আইন দিয়েই প্রাণীদের রক্ষা সম্ভব হবে না। প্রয়োজন মানুষকে সচেতন করে তোলা।
প্রাণী আমাদের জীবনকে পূর্ণ করে। তাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখানো মানে শুধু তাদের অস্তিত্ব রক্ষা নয়, বরং প্রকৃতি ও মানবতার ভারসাম্য বজায় রাখা। বিশ্ব প্রাণী দিবস এই বার্তাকেই পুনরায় জাগ্রত করে।
বিশ্ব প্রাণী দিবস শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি মানবতার আয়নায় একটি প্রশ্ন, আমরা কেমন মানুষ হতে চাই? যারা প্রাণী ধ্বংস করে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে, নাকি যারা সহমর্মিতা ও সচেতনতার আলোয় প্রাণীর অধিকারকে সম্মান জানায়?প্রাণী রক্ষা করা মানেই প্রকৃতি রক্ষা করা, আর প্রকৃতি রক্ষা করা মানেই মানুষকে রক্ষা করা। সহমর্মিতা আর সচেতনতা ছাড়া প্রাণী ও মানুষ একসাথে টিকে থাকতে পারবে না। তাই প্রতিদিনই আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক, প্রাণীর অধিকার রক্ষা করো, প্রকৃতি বাঁচাও, আর মানবতাকে অক্ষুণ্ণ রাখো।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন