নিরাপদ মৃত্যু এখন স্বপ্নের মতো। ঘরে, পথে, হাসপাতালে, থানায় কিংবা জেলে—
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।
সময়টা বড্ড খারাপ যাচ্ছে। ভুল। মানুষের সহিষ্ণুতার মাত্রা কমে গেছে। ঘুমন্ত ছেলেটাকে যে আরেকজন হাতুড়ি দিয়ে হত্যা করল—সেটা দেখে গতরাতে ঘুম আসেনি। কী এসব! পাথর মেরে খুন, কুপিয়ে কিংবা গুলি করে খুন! মানুষ মারা এখন পিঁপড়া মারার চেয়েও হালকা হয়ে গেছে। সামান্য কথা-কাটাকাটি থেকেই খুন? সামান্য স্বার্থে আঘাত হলেই জখম? বন্ধুত্ব, মনুষ্যত্ব, বিশ্বস্ততা ও ভ্রাতৃত্ব টিকে থাকবে কীভাবে? এত তুচ্ছ কারণে মানুষ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে—যা ইতিহাসে বিরল। মানবসভ্যতার যে নতুন রূপ চোখে পড়ছে তাতে সুস্থতার কোনো ছাপ নেই। শক্তি ও ষড়যন্ত্রের আগ্রাসন সম্পর্কের শিকড় পর্যন্ত ধ্বংস করছে। হৃদয় থেকে দয়া-দরদ, মায়া-মমতা কোথায় হারিয়ে গেল? মানুষের মনে এমন হিংস্রতা ও নৃশংসতা এলো কোথা থেকে?
স্কুলের বন্ধুত্বে সামান্য কথা-কাটাকাটি হলেই তা হাতাহাতিতে রূপ নিচ্ছে। খুন-জখমের নজির অসংখ্য। কিশোরদের মানসিক বিকারে পাড়াপড়শি অস্থির। বন্ধু, সহকর্মী, সহযোদ্ধা কিংবা সহধর্মী—কে কার কাছে নিরাপদ? অসহিষ্ণুতার মাত্রা স্মরণকালের সব সীমা অতিক্রম করেছে। উগ্রতা এখন জাতীয় নাস্তা। কোনো বিষয়ে যুক্তি-তর্কের অবকাশ নেই। কথায় কথায় আক্রমণ। শক্তির দাপটেই শ্রেষ্ঠত্ব কায়েমের চেষ্টা। মতাদর্শের দমন থেকে আর কোনো মতাদর্শের জন্ম হয় না। দমন-পীড়ন এখন জাতীয় হাতিয়ার। বিরুদ্ধমত, ভিন্ন অবস্থান কিংবা প্রশ্ন তোলা—সবই চরমভাবে অপছন্দ। ঘুরতে যাওয়া বান্ধবী রক্ষা পায় না, ঘুমন্ত বন্ধুকেও হত্যা করে বন্ধু। সেই জাহিলিয়াতই যেন ফিরে এসেছে। নেশা ও নারী, পদ ও ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও অকৃতজ্ঞতার কারণে লাশের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
নিরাপদ মৃত্যু এখন স্বপ্নের মতো। ঘরে, পথে, হাসপাতালে, থানায় কিংবা জেলে—কোথাও নিশ্চয়তা নেই। জনতার উত্থান ক্রমেই হিংস্র হচ্ছে। কবরের লাশ, সুরক্ষিত নারী কিংবা নির্দোষ শিশু—কেউ রক্ষা পাচ্ছে না। প্রতিশোধের পারদ ক্রমাগতই ঊর্ধ্বমুখী। অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে প্রাণ বাঁচে না। ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপত্তার পূর্ণতা নেই। নিজের জীবন নিজেকেই রক্ষা করতে হয়। সম্পদের বিনিময়ে সম্মান রক্ষার খেলা চলছে। আগ্রাসীদের দমনে উদ্যোগ অল্প। অনাকাঙ্ক্ষিত অপঘাতে জীবনের গল্প সংক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে। যার জনবল আছে, সে অযৌক্তিক দাবিও আদায় করছে। সত্য কাঁদছে, মানবাধিকার দুর্বলতায় মাথা নত করছে। বক্তৃতার সঙ্গে সমাজব্যবস্থার বিস্তর অমিল। ভাগ্যের দোহাই এখন সান্ত্বনার অবলম্বন। দায়িত্বে অবহেলা ও এখতিয়ারের বাইরে চলা চরিত্রে পরিণত হয়েছে। কেউ কারো জবাবদিহিতার গণ্ডিতে নেই।
মানুষ এমন উন্মাদের মতো আচরণ করছে কেন? হাতুড়ির উপর্যুপরি আঘাতে ঘুমন্ত জীবনের অবসান ঘটানো কি চাট্টিখানি কথা? হৃদয় এতটা পাষাণ হলো কীভাবে? ভাষার ব্যবহার হচ্ছে কদর্য। মা-বোনের কেউ বাদ যাচ্ছে না। সামান্য কারণেও রক্তারক্তি আজ মামুলি ঘটনা। সাধারণ মানুষ দর্শক হয়ে হিংস্রতা উপভোগ করছে। খুনখারাবি, জখম-লড়াই দেখলে দাঁড়িয়ে যায়, হাততালি দেয়। সংবাদপত্র যে জঘন্যতা বহন করে, পাঠক আগ্রহে পড়ে। বিশ্বাসের চরম অধঃপতন, ভরসার ক্ষয়—এসব দেখে কারো ভাবান্তর হয় না। বিরুদ্ধ দল বা মতের মানুষকে হত্যা করা, আঘাত করা জায়েজ—এমন ন্যারেটিভ প্রায় প্রতিষ্ঠিত। যারা মানবিকতার প্রচার করতে চায় তারা দেশীয় পাণ্ডাদের সংশোধনের উদ্যোগ নেয় না। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে থাকা মাদক ও উন্মত্ততা সভ্যতার পতন ঠেকানোকে প্রায় অসম্ভব করে তুলছে।
আশার প্রদীপ নিভু নিভু করছে। শঙ্কা ও অনিরাপত্তায় মানুষ রোগ-শোকে জর্জরিত। স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবতার এমন অমিল আর কবে দেখা গিয়েছিল? জানমালের না হোক, অন্তত জীবনের নিরাপত্তা প্রয়োজন। মানুষকে যদি বেঘোরে প্রাণ হারাতে হয় তবে সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রয়োজন কী? মানুষ ভালো-মন্দ বোঝার পরও যেমন আচরণ করছে তা সুস্থতার দিকনির্দেশ দেয় না। আইনের ভাষার চেয়ে প্রয়োগ আরও মসৃণ করা আবশ্যক। জীবনের দাম নিয়ে দরকষাকষি চলে না। জীবনের নিরাপত্তা মৌলিক অধিকারের অংশ। তা নিশ্চিতে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বলা সহজ হয়। ষড়যন্ত্রকারীরা উৎসবের অপেক্ষায় মুখিয়ে আছে। আমরাই হয়ত সেটির বাস্তবায়নের প্লট তৈরি করে দিচ্ছি। যুক্তিবোধ, দায়বোধ ও দায়িত্ববোধ সক্রিয় হলে মানুষ বাঁচবে। আমরা চাই মানুষের নিরাপদে বেঁচে থাকার মতো একটি সামাজিক রাষ্ট্র।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন