আওয়ামী লীগের বাইরে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল যদি এ সমস্যার সমাধান করত, তা হয়তো সার্বজনীন হতো না
রাজু আহমেদ, কলামিস্ট।
পিনাকী ভট্টাচার্যের মতো কেউ যদি দাবি করে যে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা মাত্র দুই হাজার, সেটি নিঃসন্দেহে অসংলগ্ন এবং অগ্রহণযোগ্য। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা এবং তাদের এদেশীয় দোসররা মিলে এত কম মানুষ হত্যা করেছে—এমনটা শয়তানও হয়ত বিশ্বাস করবে না, আবার ফেরেশতার চরিত্রের কেউ এমন কথা বলবে না। তবে ঐতিহাসিক তথ্যের সত্যতা আবেগ দিয়ে নয় বরং দলিল দিয়ে প্রমাণ করতে হয়।
মাত্র ছত্রিশ দিনের অভ্যুত্থানে যখন দেশীয় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়, তখন পাকিস্তানি কসাইদের নয় মাসব্যাপী দমন-পীড়নের প্রকৃত সংখ্যা সহজেই অনুমেয়। প্রশ্ন হলো—মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা আসলে কত? ত্রিশ লাখের বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক আজও থেমে নেই। কিছু মনে হয় কম, কিছু মনে হয় বেশি। অথচ প্রকৃত হিসাব নির্ধারণে রাজনৈতিক পার্থক্য কিংবা অনুমান কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।
শহীদের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ করে ইতিহাসকে পরিষ্কারভাবে প্রতিষ্ঠা করা এখনো সম্ভব। প্রতিটি জেলায় জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে এবং প্রতিটি উপজেলায় ইউএনওর সভাপতিত্বে নিহতদের সঠিক তালিকা প্রস্তুত করা কঠিন কোনো কাজ নয়। বরং আরও দশক পার হলে এই কাজ জটিল হয়ে পড়বে, কারণ মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী প্রজন্ম দ্রুত বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য—আমরা এক আত্মভোলা ও অকৃতজ্ঞ জাতি। স্বাধীনতার চুয়ান্ন বছরেরও বেশি সময় পার হলেও শহীদদের প্রামাণ্য তালিকা তৈরি হয়নি। রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের দ্বারা রাজাকারদের একটি তালিকা প্রস্তুত হয়েছিল বটে, তবে সেটিও ছিল চরম বিতর্কিত। অথচ মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা ধারণ করতে হলে প্রথম কাজ হওয়া উচিত ছিল শহীদদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ।
স্বাধীনতা পরবর্তী এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ত্রিশ লাখ শহীদের কথা বলেছিলেন। তবে সেই সংখ্যার উৎস এবং প্রেক্ষাপট নিয়েও বিতর্ক আছে। মুক্তিযোদ্ধা ফোরামের অনেক সদস্য সেই সংখ্যা স্বীকার করেননি। তবে দ্বিমত করেছিলেন এমন সংখ্যাও তৎকালে বেশি ছিল না। কেননা দ্বিমতের সুযোগ ছিল না।পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ যখন সরকারে আসে, তখন আদালতের মাধ্যমে এই বিষয়ে রায় লেখানো পর্যন্ত গড়ায়। অথচ স্বাধীনতার প্রথম কয়েক বছরেই এই সমস্যার সমাধান করা উচিত ছিল।
আওয়ামী লীগের বাইরে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল যদি এ সমস্যার সমাধান করত, তা হয়তো সার্বজনীন হতো না। এ কারণে বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে গেছে এবং বহু প্রজন্মের সামনে ইতিহাসের স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরার সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে।
যদি শহীদের সংখ্যা ত্রিশ লাখ ধরি, তাহলে নয় মাসে (২৬৬ দিন) প্রতিদিন গড়ে ১১,২৭৮ জন, প্রতি ঘণ্টায় ৪৭০ জন এবং প্রতি মিনিটে আটজন শহীদ হয়েছেন। এই সংখ্যাটি শুনতে অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে, কিন্তু যুদ্ধের প্রকৃত ভয়াবহতা বিবেচনায় তা অসম্ভব নয়। ৬৪টি জেলায় গড়ে প্রায় ৪৬,৮৭৫ জন নিহত হওয়ার সমীকরণ দাঁড়ায়। আর যদি ৬৮ হাজার গ্রামে ভাগ করি, তাহলে প্রতি গ্রামে গড়ে ৪৪ জন শহীদের সংখ্যা দাঁড়ায়। যদিও বাস্তবে শহর ও নগরে হত্যাযজ্ঞ বেশি ছিল, তবুও যেসব গ্রামে পাক সেনারা প্রবেশ করেছিল, সেসব গ্রামেই ভয়ংকর হত্যালীলা সংঘটিত হয়েছে।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পার হলেও এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সমাধান হয়নি। শহীদ সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক চলছেই, আবার মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা তালিকায় ভুয়া নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অভিযোগও আছে। স্বাধীনতার মহান অর্জনকেও আমরা রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক সুবিধার উপকরণে পরিণত করেছি।
ইতিহাসের দায় এড়িয়ে যাওয়া যায় না। শহীদ সংখ্যা নিরূপণ কেবল পাকিস্তানকে দায়ী করার বিষয় নয়, বরং এটি আমাদের আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন। সংখ্যার ধোঁকাবাজি বন্ধ না করলে ইতিহাস বিকৃত হতে থাকবে, এবং জাতির মেরুদণ্ড আরও ক্ষয়প্রাপ্ত হবে।
এখনো সময় আছে। স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস রক্ষার স্বার্থে শহীদদের সংখ্যা নির্ভুলভাবে নথিবদ্ধ করতে হবে। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ করা হোক, জুলাইয়ের হত্যাযজ্ঞের নিখুঁত তালিকাও তৈরি হোক। ইতিহাস বিকৃতির অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বের হয়ে জাতিকে সত্য ও বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধ কোনো দলীয় সম্পত্তি নয়, এটি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন। তাই শহীদদের সংখ্যা নির্ধারণে কোনো রাজনৈতিক সমীকরণ নয়, বরং জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন। প্রকৃত সংখ্যা যতই হোক না কেন, তা নিরূপণ করার মধ্য দিয়েই শহীদদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান জানানো সম্ভব।
শহীদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণের মধ্য দিয়ে আমরা শুধু অতীতকে সঠিকভাবে রক্ষা করি না, বরং পরবর্তী প্রজন্মকে ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত করি। গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও মানবিকতার মূল্যের প্রতিফলন এ কাজেই সম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি শুধু রাজনৈতিক বিষয় নয়, এটি আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও মর্যাদার প্রতীক।
এবারের প্রজন্মের দায়িত্ব হচ্ছে—সঠিক তথ্য সংগ্রহ, প্রামাণ্য তালিকা তৈরি এবং ভুল ইতিহাসের বিস্তার রোধ করা। এটি না হলে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, শহীদদের আত্মত্যাগ এবং দেশের স্বাধীনতার মূল্য পরবর্তী প্রজন্মে সঠিকভাবে পৌঁছাবে না। তাই সকল রাজনৈতিক দলের সীমা অতিক্রম করে, জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে সত্য ও বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ানো একান্ত প্রয়োজন।
শহীদের সংখ্যা নিরূপণ করতে গিয়েই আমরা বুঝতে পারি—একটি জাতির ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা শুধু অতীতের হিসাব নয়, বরং ভবিষ্যতের ভিত্তি। যারা আত্মত্যাগ করেছেন, তাদের স্মৃতি ও আত্মমর্যাদা রক্ষা করা নাগরিকদের অধিকার এবং কর্তব্য। এই দায়িত্ব অবহেলা করা জাতিকে ইতিহাসের সামনে অসহায় করে তোলে।
শহীদদের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ জাতির দায়—এটি শুধুমাত্র একটি গাণিতিক হিসাব নয়, এটি আমাদের জাতীয় চরিত্র, ঐতিহ্য ও মর্যাদার প্রতিফলন। এ দায়িত্ব পালন ছাড়া স্বাধীনতার প্রকৃত চেতনা রক্ষা করা অসম্ভব।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন