দ্বৈত কূটনীতির পাঠ: গাজার রক্তক্ষয়ে ইসরাইলের পাশে মোদি, আর নির্বাসনে শেখ হাসিনা

gbn

সহিদুল আলম স্বপন,  সুইজারল্যান্ড ||

গাজার যুদ্ধক্ষেত্রে বেনজামিন নেতানিয়াহুর হাত শক্ত করছেন নরেন্দ্র মোদি, আর দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বিতর্কিত শেখ হাসিনাকে দিচ্ছেন আশ্রয়—দুই ঘটনাই ভিন্ন প্রেক্ষাপটের হলেও, মোদি সরকারের কূটনৈতিক কম্পাসে এরা একই সূত্রে বাঁধা। প্রতিরক্ষা জোট, আঞ্চলিক প্রভাব ও গৃহরাজনীতির হিসাব মিলে তৈরি হচ্ছে এমন এক পররাষ্ট্রনীতি, যা একদিকে বাস্তববাদী, অন্যদিকে নৈতিক প্রশ্নে বিতর্কিত। বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, কীভাবে দিল্লি একসাথে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার দাবার বোর্ডে নিজের গুটি সাজাচ্ছে।

বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে নরেন্দ্র মোদি আজ এমন এক চরিত্র, যিনি একই সাথে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই পরিস্থিতিতে একধরনের নির্দিষ্ট কূটনৈতিক কৌশল প্রয়োগ করছেন। একদিকে তিনি গাজার রক্তক্ষয়ী সংঘাতে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুর পাশে দাঁড়াচ্ছেন, অন্যদিকে বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দিচ্ছেন।

দুটি ঘটনাই রাজনৈতিকভাবে ভিন্ন—তবে উভয়ের পেছনে রয়েছে মোদি সরকারের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্বার্থ, নিরাপত্তা-নীতি, এবং ব্যক্তিগত নেতৃত্বের ব্র্যান্ডিংয়ের মিশ্রণ।

গাজার রক্তক্ষয়ে ইসরাইলের পাশে মোদি

ভারতের স্বাধীনতার পরবর্তী দীর্ঘ সময় পর্যন্ত দেশটি প্যালেস্টাইনের দৃঢ় সমর্থক ছিল। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকে ইসরাইলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে ভারত তার কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে শুরু করে। মোদি ক্ষমতায় আসার পর সেই পরিবর্তন কেবল গতি পায়নি—বরং একপ্রকার দৃঢ় জোটে রূপ নিয়েছে।

প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি সহযোগিতা

ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অস্ত্র আমদানিকারক দেশ, আর ইসরাইল ভারতের জন্য শীর্ষ তিন অস্ত্র সরবরাহকারীর একটি। উন্নত ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, সাইবার সিকিউরিটি—সবক্ষেত্রেই ইসরাইল ভারতের একটি অপরিহার্য অংশীদার। গাজার ঘটনায় ইসরাইলকে সমর্থন দিয়ে মোদি শুধু রাজনৈতিক অবস্থানই নেননি, বরং এই সামরিক ও প্রযুক্তিগত সম্পর্কের স্থায়িত্বও নিশ্চিত করেছেন।

সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থান

মোদি সরকার প্রায়শই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ইস্যুতে কঠোর অবস্থান নেয়। গাজায় ইসরাইলের সামরিক অভিযানকে অনেকটা ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’-এর অংশ হিসেবে তুলে ধরে তিনি অভ্যন্তরীণ ভোটব্যাংকে একটি শক্তিশালী বার্তা দেন—যে ভারত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন।

গৃহরাজনীতি ও হিন্দুত্ববাদী আদর্শ

হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে ইসরাইলকে প্রায়শই একটি ‘আদর্শ রাষ্ট্র’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়—যেখানে কঠোর নিরাপত্তা, অভিন্ন ধর্মীয় পরিচয়, এবং সীমান্ত রক্ষার uncompromising মনোভাব রয়েছে। এই বয়ান মোদির মূল সমর্থক গোষ্ঠীর সাথে সাযুজ্যপূর্ণ।

আন্তর্জাতিক অবস্থান

মোদি ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে “ডি–হাইফেনেশন” কৌশল প্রয়োগ করছেন—প্যালেস্টাইনকে সমর্থন জানালেও, ইসরাইলের সাথে সম্পর্ককে পৃথকভাবে এগিয়ে নেওয়া। ফলে জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভারত প্রায়ই নিরপেক্ষ থাকে বা ইসরাইলপন্থী অবস্থান নেয়।

শেখ হাসিনাকে আশ্রয়—মানবিক না কৌশলগত সিদ্ধান্ত?

২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন এবং ভারতে প্রবেশ করেন। এর পরপরই তাঁকে অস্থায়ী আশ্রয় দেওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। বিষয়টি বাংলাদেশে অনেকের কাছে সংবেদনশীল এবং বিতর্কিত।

ঐতিহাসিক সম্পর্ক

১৯৭৫ সালের ট্র্যাজেডির পর শেখ হাসিনা প্রথমে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই স্মৃতি ও মানবিক বিবেচনাই মোদি সরকারের জন্য একটি ‘নৈতিক যুক্তি’ তৈরি করে। কিন্তু এই যুক্তি এখন আর তার দেশেই ধোপে টিকছে না। হাসিনা তথা আওয়ামিলীগকে প্রমোট করা মোদি তথা ভারত বাংলাদেশের মানুষের আস্থা হারিয়েছে। 

আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা

বাংলাদেশ ভারতের পূর্ব সীমান্তে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। শেখ হাসিনার আমলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক তুলনামূলক উষ্ণ ছিল—সীমান্ত নিরাপত্তা, বিদ্যুৎ বিনিময়, আঞ্চলিক বাণিজ্য—সবক্ষেত্রেই সহযোগিতা হয়েছে। তাঁকে আশ্রয় দিয়ে মোদি হয়তো ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ ধরে রাখতে চাইছেন।

চীনের প্রভাব ঠেকানো

বাংলাদেশের নতুন সরকার চীনের দিকে ঝুঁকতে পারে—এটি ভারতের জন্য উদ্বেগজনক। শেখ হাসিনাকে কাছে রাখা ভারতের জন্য এক ধরনের “কূটনৈতিক বীমা”, যাতে ঢাকায় চীনা প্রভাব অতিমাত্রায় বিস্তার না পায়।

মানবিক যুক্তি ও আন্তর্জাতিক ইমেজ

ভারত নিজেকে একটি আঞ্চলিক মানবিক শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চায়। রাজনৈতিক শত্রুকেও আশ্রয় দেওয়ার সংস্কৃতি তারই অংশ। এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভারতকে ‘দায়িত্বশীল আঞ্চলিক শক্তি’ হিসেবে উপস্থাপন করে।

 দ্বৈত কূটনীতি নাকি কৌশলগত সামঞ্জস্য?

অনেকে মোদি সরকারের এই দুই পদক্ষেপকে ‘দ্বৈত মান’ বলে সমালোচনা করেন—একদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে থাকা ইসরাইলকে সমর্থন, অন্যদিকে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অভিযোগে থাকা শেখ হাসিনাকে আশ্রয়। কিন্তু পররাষ্ট্রনীতিতে নৈতিকতা সবসময় সরল সমীকরণে মেলে না।

স্বার্থ বনাম নীতি

আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে জাতীয় স্বার্থ প্রায়ই মানবাধিকার ও নৈতিক অবস্থানের চেয়ে অগ্রাধিকার পায়। ইসরাইলের ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি, শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও প্রভাব—দুটোই ভারতের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের অংশ।

এই পদক্ষেপগুলো বিশ্বকে বার্তা দেয় যে, ভারত তার মিত্রদের পাশে থাকে—যা-ই ঘটুক না কেন। এটি বন্ধু রাষ্ট্রদের কাছে ভারতের নির্ভরযোগ্যতা বাড়ায়।

তবে এর ফলে ভারত গ্লোবাল সাউথের কিছু দেশের কাছে নৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে পারে, আবার বাংলাদেশের জনমনে ভারতবিরোধী মনোভাবও দিন দিন বাড়তেই থাকবে।

অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া - ভারতের ভেতরে মোদির ইসরাইল সমর্থন বিজেপি ভোটারদের মধ্যে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া আনে, কিন্তু বিরোধী শিবিরে সমালোচনা তৈরি করে। শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়া নিয়েও জাতীয়তাবাদী মহলে প্রশ্ন ওঠে—কেন ভারত অন্য দেশের বিতর্কিত নেতাদের আশ্রয় দেবে?

আন্তর্জাতিকভাবে মিত্র রাষ্ট্রগুলো ভারতের অবস্থানকে বাস্তববাদী ও স্থিতিশীল হিসেবে দেখে। তবে কিছু আরব দেশ ও প্যালেস্টাইনপন্থী সংগঠন ভারতের ইসরাইল সমর্থনকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখছে।

মোদি কূটনীতির পাঠ - নরেন্দ্র মোদির এই দুই ভিন্ন পরিস্থিতিতে নেয়া পদক্ষেপ আসলে একই কূটনৈতিক সূত্রে বাঁধা—প্রথম সূত্র: জাতীয় নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বার্থ সর্বাগ্রে।দ্বিতীয় সূত্র: আঞ্চলিক প্রভাব ধরে রাখা। তৃতীয় সূত্র: অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বার্তা নিশ্চিত করা।

গাজার যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইসরাইলকে সমর্থন দিয়ে মোদি আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্বকে শক্তিশালী করছেন। আর শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক দাবার বোর্ডে একটি গুরুত্বপূর্ণ গুটি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখছেন।

তবে এই কৌশল টেকসই হবে কিনা, তা নির্ভর করবে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত কোন দিকে মোড় নেয় তার ওপর। ইতিহাস দেখিয়েছে—কূটনীতির মঞ্চে দীর্ঘমেয়াদে কেবল স্বার্থই টিকে থাকে, কিন্তু নৈতিকতার প্রশ্ন চিরকাল বিতর্কের খোরাক হয়ে যায়।

লেখক: সহিদুল আলম স্বপন,  সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বেসরকারি ব্যাংকিং আর্থিক অপরাধ বিশেষজ্ঞ, কলামিস্ট ও কবি

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন