ইসরায়েলি হামলায় রক্তাক্ত রাফাহ গভীর রাতে ঘুমন্ত মানুষের ওপর হামলা, নিহত ১০০

তখন গভীর রাত। রাফাহর শরণার্থীশিবিরের তাঁবুগুলোতে অনেকেই পেটে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ বিকট শব্দে ইসরায়েলি বাহিনীর জঙ্গি বিমান, ট্যাংক ও যুদ্ধজাহাজ একযোগে হামলা চালায় তাদের ওপর। ঘুম ভেঙে কিছু বুঝে ওঠার আগেই বোমা ও গোলায় রক্তাক্ত ও ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় শরণার্থীশিবিরের বহু নিরীহ মানুষ।

 

ফিলিস্তিনের দক্ষিণ গাজার রাফাহ শহরে রবিবার রাতে ভয়ংকর এই হামলায় নারী, শিশুসহ অন্তত ১০০ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে বহু মানুষ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে শুধু শরণার্থীশিবিরেই নয়, আরো একাধিক স্থানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এই আগ্রাসী হামলা ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের পরিচালিত ‘গণহত্যামূলক যুদ্ধের ধারাবাহিকতা’ বলে তীব্র ক্ষোভ জানিয়েছে গাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংগঠন হামাস।

 

মসজিদসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা

ইসরায়েলের বোমায় রাফাহর শবোউরা এলাকায় ইয়াবনা শিবিরের আর-রাহমা মসজিদ ও আল হুদা মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই দুটি মসজিদে বাস্তুচ্যুত বহু মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। ওই এলাকার একটি হাসপাতালের কাছেও ব্যাপক গোলাবর্ষণের খবর পাওয়া গেছে। ইসরায়েলি বাহিনী জানিয়েছে, তারা শবোউরা এলাকার একটি বাড়ি থেকে দুই জিম্মিকে উদ্ধার করেছে।

 

বার্তা সংস্থা এএফপির সাংবাদিক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, তাঁরা রাফাহতে রাতভর দফায় দফায় বিকট শব্দে বোমাবর্ষণের আওয়াজ শুনতে পেয়েছেন। শহরের আকাশে কালো ধোঁয়া উড়তে দেখেছেন। তাঁরা এই হামলাকে নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করেছেন।

স্থানীয়রা জানিয়েছে, ইসরায়েলি সেনারা শহরের উত্তরাংশে এবং মধ্যাঞ্চলে কয়েক ডজন বিমান হামলা চালিয়েছে। শহরে চালানো এই হামলায় বিমান ও সাগরপথে যুদ্ধজাহাজগুলো অংশ নিয়েছে।

 

অনেক বাসিন্দা জানিয়েছে, রাতে হামলা শুরুর সময় তারা অনেকেই ঘুমিয়েছিল। হঠাৎ করে ব্যাপক বোমাবর্ষণের শব্দে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে তারা। রাফাহতে ইসরায়েল স্থল হামলা শুরু করে দিয়েছে দেখে তারা উদ্বিগ্ন।

রাফাহর শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া সাইদ আল হামস বলেন, বোমায় তাঁর পরিবারের ৪০ দিন বয়সী এক শিশু মারা গেছে। বিভীষিকাময় রাতের কথা বলতে গিয়ে আবু সুহাইব নামের আরেক ফিলিস্তিনি জানান, ‘পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠেছিল যেন আমরা নরকের মধ্যে পড়ে গেছি। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছি। যেন নরক নেমে এসেছে পৃথিবীতে।’ আবু আবদুল্লাহ নামের আরেক ফিলিস্তিনি বলেন, ‘কিভাবে এমন ভয়ের রাতটা পার করেছি, তা ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না। ওরা আমার এক ভাইকে হত্যা করেছে। বোমা ও গোলায় বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে।’

ফিলিস্তিনে কাজ করা রেড ক্রিসেন্ট জানায়, রাফাহ শহর এক ভয়ানক সহিংস আক্রমণের সাক্ষী হয়েছে। রাফাহ শহরের মধ্যাঞ্চলে তাদের সদর দপ্তরের আশপাশের এলাকায় বিমান হামলা হয়েছে। সেখানে তাদের রেড ক্রিসেন্টের দপ্তরের বিপরীতে একটি বাড়িতে বোমা হামলা হয়েছে। এসব হামলায় মানুষের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এদিকে হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, রাফাহ শহরে হামলায় অন্তত ১০০ জন নিহত হয়েছে।

হাসপাতালজুড়ে শুধু আহাজারি

রাফাহর কুয়েতস হাসপাতালের পরিচালক সুহাইব আল-হামস বলেছেন, আহত লোকজনে হাসপাতাল ভরে গেছে। অনেকের অবস্থাই গুরুতর। হাসপাতালে তাদের চিকিৎসা দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত ওষুধও নেই। 

জানা গেছে, রাফাহ শহরে সম্ভাব্য স্থল অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরায়েল। এর আগে তারা সেখানে বিমান হামলা তীব্র করেছে।

গাজা সিটি থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের একটি শহর রাফাহ। মিসর সীমান্তসংলগ্ন এই শহরটি এখন গাজার বাস্তুচ্যুত বিপুলসংখ্যক মানুষের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। সেখানে এখন প্রায় ১৫ লাখ মানুষ রয়েছে। হামাস-ইসরায়েল লড়াই শুরু হওয়ার পর শহরটিতে জনসংখ্যা আগের তুলনায় পাঁচ গুণ বেড়েছে। লোকারণ্য হয়ে ওঠা শহরটির প্রতি স্কয়ার কিলোমিটারে ১৬ হাজার মানুষ বাস করছে বলে ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি জানিয়েছে। বহু মানুষ গাদাগাদি করে তাঁবু খাটিয়ে সেখানে থাকছে। শহরের মেয়র জানিয়েছেন, এত বিপুলসংখ্যক মানুষের চাহিদার তুলনায় খুব অল্প পরিমাণ ত্রাণ মিলছে। শহরে আশ্রয় নেওয়া বাস্তুচ্যুত মানুষ অনাহারে, রোগশোক নিয়েই বেঁচে থাকার ক্রমাগত লড়াই করে যাচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু রাফাহতে স্থল অভিযান চালানোর হুঁশিয়ারি দেওয়ার পর থেকে শহরজুড়ে উদ্বেগ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। জনাকীর্ণ শহরটিতে ইসরায়েল আগ্রাসী হামলা চালালে সেখানে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে বলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি আরব দেশগুলোও সাবধান করেছে।

ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির মুখপাত্র নেবেল ফারসাখ বলেছেন, গাজায় এখন এমন কোনো নিরাপদ জায়গা নেই যেখানে এই ফিলিস্তিনিরা যেতে পারে। তবে নেতানিয়াহু কাউকেই তোয়াক্কা করছেন না। তিনি এখনো তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছেন। এর মধ্যে তাঁর বাহিনী গত রবিবার রাতে রাফাহতে ব্যাপক তাণ্ডব চালাল।

এদিকে বিমান হামলার পর গতকাল সোমবার বেশ কিছু পরিবার রাফাহ ছাড়ার প্রস্তুতি নেয়। এদের একজন আলা মোহাম্মেদ। তিনি জানান, তাঁরা একটি বিভীষিকাময় রাত পার করেছেন। সামনে রাফাহর ভাগ্যে কী ঘটতে চলেছে, তা রবিবার রাতের নারকীয় হামলাতেই পরিষ্কার হয়ে গেছে। ইসরায়েলি  সেনারা যে তাদের ঘোষণা অনুযায়ী শহরে ঢুকবে, তা বোঝাই যাচ্ছে। আলা জানান, তাঁরা দেইর আল বালাহ শহরে যাবেন বলে ঠিক করেছেন। যদিও মধ্যগাজার এই শহরটিও ইসরায়েলি হামলার হাত থেকে নিরাপদ নয়।

দুই জিম্মি উদ্ধার

ইসরায়েলি বাহিনী জানিয়েছে, রাফাহতে রবিবার রাতে অভিযান চালিয়ে তারা লুইস হার (৭০) ও ফারনান্দো সাইমন মারমেন (৬০) নামের দুই জিম্মিকে মুক্ত করেছে। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি জনপদে হামাস নজিরবিহীন হামলা চালানোর সময় এই দুজনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে তাঁরা গাজায় হামাসের হাতে বন্দি ছিলেন।

এদিকে রাফাহতে হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ইসরায়েল বেসামরিক মানুষকে লক্ষ্যবস্তু করেই যাচ্ছে। তারা এই যুদ্ধ রাফাহতে নিয়ে যাচ্ছে। বোমাবর্ষণ করে সেখানকার মানুষকে আশ্রয়চ্যুত করতে চাইছে। 

চার মাসে ২৮ হাজার ৩৪০ ফিলিস্তিনি নিহত

গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। সরকারি সূত্রের বরাতে এএফপি জানায়, ইসরায়েলে হামাসের এই হামলায় অন্তত এক হাজার ১৬০ জন নিহত হয়। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক। ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে হামাস অন্তত ২৫০ জনকে জিম্মি করে। জিম্মিদের মধ্যে শতাধিক ব্যক্তিকে গত নভেম্বরের শেষের দিকের এক সপ্তাহব্যাপী যুদ্ধবিরতির সময় ছেড়ে দেয় হামাস।

ইসরায়েল বলেছে, গাজায় এখনো প্রায় ১৩০ জন জিম্মি রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অন্তত ২৯ জন নিহত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। জবাবে ৭ অক্টোবর থেকেই গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। গাজার হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, চার মাস ধরে চলা ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ২৮ হাজার ৩৪০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। হামলায় আহতের সংখ্যা প্রায় ৬৮ হাজারে দাঁড়িয়েছে।

জিবিডেস্ক //

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন