হুসনা খান হাসি॥
স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। স্বপ্নই মানুষকে আকাশ ছোঁয়ার সাহস দেয়। কেউ বিজ্ঞানী হতে চায়, কেউ লেখক, কেউ চায় নিজের ছোট্ট একটা দোকান হোক, কেউ বা স্রেফ একটু নিরাপদ, শান্ত জীবন। স্বপ্নের রং আলাদা হলেও, সব স্বপ্নের পেছনেই থাকে একরকম তৃষ্ণা, নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার। কিন্তু সমস্যা তখনই শুরু হয়, যখন মানুষ ভাবে তার এই স্বপ্ন পূরণ করবে অন্য কেউ।
কেউ চায় তার স্বামী তাকে জীবনভর সাহায্য করবে স্বপ্ন পূরণে; কেউ চায় স্ত্রী তার সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবে, যাতে সে নিজের স্বপ্নে ডুবে থাকতে পারে। কখনোবা চাওয়া থাকে মা-বাবা, ভাই-বোন, বা কোনো আত্মীয়স্বজনের দিকে। অথচ বাস্তবতা বলছে, স্বপ্ন যতই হোক তোমার, তা পূরণের দায়িত্বও একান্তই তোমার। নিজের স্বপ্নকে বাস্তব করতে হলে, কষ্টটা নিজেরই করতে হয়।
বহু মানুষই শুধু স্বপ্ন দেখেই থেমে যায়। তারা সেই স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পরিশ্রম, আত্মত্যাগ, সময় বা সাহস দেখাতে পারে না। তারা ভাবে, কেউ একজন এসে তাদের স্বপ্নটিকে বাস্তবে রূপ দেবে। কিন্তু এভাবে স্বপ্ন ফানুসের মতো হয়ে পড়ে, দেখতে সুন্দর, আলো ঝলমলে, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে নিভে যায়, হারিয়ে যায় অন্ধকারে।
স্বপ্ন যদি হয় বেলুন, তবে তার ভেতর থাকতে হবে বাস্তবতার অক্সিজেন। শুধু হাওয়ায় ভরা স্বপ্ন যে কোনো সময় ফেটে যেতে পারে। "যেমন কর্ম তেমন ফল"—এই প্রবাদটি যেন স্বপ্ন দেখার এই যুগে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। কেবল স্বপ্ন দেখলেই হবে না, তাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে চাই নিরন্তর প্রচেষ্টা, আত্মনিবেদন ও দায়িত্ববোধ।
অন্য কেউ তোমার হয়ে স্বপ্ন দেখতে পারে না, যেমন কেউ তোমার হয়ে ঘাম ঝরাতে পারে না। তাই যদি সত্যিই কোনো স্বপ্নকে সত্যি করতে চাও, তবে শুরুটা করতে হবে নিজেকেই। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, নিজের হাতেই গড়তে হবে সেই ভবিষ্যৎ, যা একদিন তুমি কেবল চোখে দেখেছিলে।
স্বপ্নকে দোষ দেওয়া যায় না, সে তো জন্মায় হৃদয়ের গভীরে। কিন্তু স্বপ্ন পূরণে দায়িত্ব এড়িয়ে চলা মানে নিজেকেই প্রতারণা করা। বাস্তবতা কঠিন, পথ কখনোই মসৃণ নয়, কিন্তু যদি সত্যিই মন থেকে কিছু চাও, তবে তার পেছনে লাগতে হবে নিজেরই পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও সাহস নিয়ে। স্বপ্নকে ফানুস না বানিয়ে তাকে মাটির শেকড় দাও। যেন সে শুধু আলো ছড়িয়ে উড়ে না যায়, বরং একদিন বাস্তবের আকাশে সত্যি হয়ে জ্বলে ওঠে। স্বপ্ন নিজের, তাই তার দায়িত্বও একান্তই নিজের।
স্বপ্ন পূরণ মানেই শুধু কোনো লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়া নয়, বরং সেই যাত্রার প্রতিটি ধাপকেই গভীরভাবে অনুভব করা। আমরা অনেকেই ভাবি, স্বপ্ন মানেই সফলতা, আর সফলতা মানেই বাহ্যিক কিছু অর্জন, টাকা, নাম, খ্যাতি। কিন্তু প্রকৃত স্বপ্নপূরণ মানে হলো, নিজের অন্তরের মধ্যে জন্ম নেওয়া এক আকাঙ্ক্ষাকে ধীরে ধীরে বাস্তব রূপ দেওয়া, নিজেকে বদলানো, গড়েপিটে নতুন করে নির্মাণ করা। এই যাত্রায় বাধা আসবেই, পরিবারের অসমর্থন, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, সামাজিক চাপ। কখনো কখনো সবচেয়ে কাছের মানুষের কাছ থেকেই আসে সবচেয়ে বড় বাধা। তখন অনেকেই মন ভেঙে ফেলে। ভাবে, যদি স্ত্রী একটু সহযোগিতা করতেন, বা স্বামী যদি বুঝতেন, তাহলে হয়তো স্বপ্নটা আজ বাস্তব হতো। কিন্তু এর চেয়েও বড় সত্য হলো, এই যাত্রা একা চলারই। সমর্থন পাওয়া সৌভাগ্যের, কিন্তু না পেলেও যাত্রা থেমে গেলে চলে না। আমাদের সমাজে নারীরা যেমন অনেক সময় তাদের স্বপ্ন বিসর্জন দেন সংসার ও সন্তানের দায়ে, তেমনি পুরুষেরাও দায়িত্বের ভারে অনেক সময় নিজেকে ভুলে যান। কিন্তু আসল কথা হলো, স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে হলে, নিজের ভেতরকার আগুনটা জ্বালিয়ে রাখতে হয়, সেটা যত ছোটই হোক না কেন। স্বপ্নপূরণ কোনো মুহূর্তের বিষয় নয়, এটি একটি প্রক্রিয়া, ধীরে ধীরে নিজেকে তৈরি করার, ভুল থেকে শেখার, হোঁচট খেয়ে আবার উঠে দাঁড়ানোর। অন্য কেউ তোমার হয়ে সেই প্রক্রিয়ার ভিত গড়তে পারবে না। তারা সাহায্য করতে পারে, পাশে থাকতে পারে, কিন্তু হেঁটে যেতে হবে তোমাকেই। এবং ঠিক এখানেই দাঁড়িয়ে ‘যেমন কর্ম, তেমন ফল’ প্রবাদটির গভীরতা বোঝা যায়। যা তুমি দেবে, তাই ফিরে পাবে। তুমি যদি স্বপ্নে বিশ্বাস করো, আর তার পেছনে নিজের সর্বস্ব ঢেলে দাও, তবে সে স্বপ্নও তোমায় ঠকাবে না। স্বপ্নকে দোষ দেওয়া যায় না, সে তো জন্মায় হৃদয়ের গভীরে। কিন্তু স্বপ্ন পূরণে দায়িত্ব এড়িয়ে চলা মানে নিজেকেই প্রতারণা করা। বাস্তবতা কঠিন, পথ কখনোই মসৃণ নয়, কিন্তু যদি সত্যিই মন থেকে কিছু চাও, তবে তার পেছনে লাগতে হবে নিজেরই পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও সাহস নিয়ে। অতএব, অন্য কারও নয়, নিজের স্বপ্নকে আপন করে তোলো। তার দায়িত্ব নাও। কারণ, শেষ পর্যন্ত সেই স্বপ্নই হবে তোমার জীবনের ঠিকানা।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন