মা-বউয়ের দ্বন্দ্ব শেষমেশ একটা সুন্দর জীবনের ইতি ঘটাতে বাধ্য করেছে
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।
চাকরি-বাকরি শুধু খেয়ে বেঁচে থাকার অবলম্বন। মানসিকভাবে বেঁচে থাকতে পারিবারিক শান্তির প্রয়োজন। সারাদিনের ব্যস্ততা সেরে মানুষ যে নীড়ে ফেরে, সেখানে সুখ-শান্তি না থাকলে সম্পদ-ক্ষমতা সব তুচ্ছ হতে থাকে। পলাশ সাহার জীবন বোধহয় সমাজকে গভীর কোনো বার্তা দিয়েই গেলো। আত্মহননের পূর্বে লিখে রাখা চিরকুটে পারিবারিক দ্বন্দ্বের কলহের ইঙ্গিত আছে। বউ ও শ্বাশুড়ি চিরাচরিত কলহের বলি হলো একটা জীবন।
মা-বউয়ের দ্বন্দ্ব শেষমেশ একটা সুন্দর জীবনের ইতি ঘটাতে বাধ্য করেছে। পরিবারে কেবল মা কিংবা কেবল বউ—এদের যেকোনো একজন খারাপ হলেও কোনোমতে টিকে থাকা যায়; কিন্তু যখন দু'জনে সমানভাবে বাড়ে, তখন পুরুষের জন্য মৃত্যুতেই সমাধান। পলাশ সাহা সাহসী বলে মরতে পেরেছে। কাপুরুষরা মরে বেঁচে যেতেও পারে না। তাদের সারা জীবন সুখ বেচে দুঃখ কিনে চলতে হয়।
চাষাভুষা হলে বউকে শাসন করে দমন করা যায়, তখন মাকেও বকা সাজে। এর কোনোকিছু না পারলে অন্তত ঘর ছেড়ে দুনিয়াকে ঘর বানানো যায়। কিন্তু শিক্ষিত পুরুষ, সামাজিকভাবে সম্মানিত পুরুষ পারিবারিক অশান্তিতে আহা-উহু পর্যন্ত করতে পারে না। সামাজিকতার কথা ভেবে তাকে যে কতকিছু সহ্য করতে হয়, অযৌক্তিক কতকিছু মেনে নিতে হয়—সেসবের ইয়ত্তা নাই। অন্যদিকে যারা খারাপ হয়, তারা কত যে খারাপ হতে পারে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। এসবের যন্ত্রণা কেবল স্রষ্টা জানে। সিনিয়র এএসপি পলাশ সাহাদের জীবন কত অশান্তির মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরে আত্মহত্যার মত আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের সাহসিকতা দেখানো যায়, তা ভুক্তভোগী জানে। নিজেকে মেরে ফেলার চিন্তা এতোটাও সহজ নয়। বাঁচার যখন আর কোনো পথ না থাকে, তখনই মানুষ মরে।
মা এবং বউয়ের আরেকটু বিবেক থাকলে পারতো! কে দোষী—নিশ্চিতভাবে জানি না; তবে দু'জনের কেউ যে ছাড় দেয়নি, সেটা চিরকুটের ভাষায় বুঝি। মা তার সন্তান হিসেবে পলাশ সাহার প্রতি সম্পূর্ণ অধিকার রাখতে চেয়েছিলেন এবং স্ত্রীও ভেবেছিল, যেহেতু তার স্বামী সেহেতু সবকিছুই তার—হয়তো। গল্প ভিন্নও হতে পারে। তবে একজন পুরুষ কম দুঃখে মরে না। যার সামনে সোনালি সুদিন, পদ-মর্যাদা এবং অর্থ-ক্ষমতা যাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিলো—সে নিজের জীবন নিয়ে ভাবেনি? বাঁচতে কার না ইচ্ছা হয়? সব পথ বন্ধ হয়ে গেলে কেবল কবর/চিতার দিকের পথটাই কেবল খোলা থাকে। পরিবারের অশান্তি ভুলতে পলাশ সাহা সেদিকেই হাঁটলেন। অথচ আরও অনেক কিছু দেখা ও করার বাকি ছিল।
পলাশ সাহার প্রতি বিস্তর অভিযোগ, আমাদের অভিমান। একজন শিক্ষিত সুপুরুষের আরও বেশি ভেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। এই দুনিয়ায় কেউ দুইবার জীবন পায় না। আত্মহত্যা সবসময়েই ছোট সমস্যার বড় সমাধান! প্রত্যেক পুরুষের মানসিক শক্তি আরও মজবুত হওয়া উচিত। দুঃখ ছাড়া মহামানবেরও জীবন হয়? প্রিয়জন দুঃখ দেবে, আবার আপনও তো হবে। শত্রু আঘাত করবে, আবার বন্ধু পাশেও তো দাঁড়াবে। আত্মহত্যার মত আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের আগে দেশের প্রতি ঋণ, মাতাপিতার প্রতি দায় এবং প্রিয়জনের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা মাথায় এলে একটা জীবন রক্ষা পেতো। একজন মানুষ মারা যাওয়া মানে কতগুলো লোককে জীবিত অবস্থাতেই কবরে শুইয়ে দেওয়া।
বিবাহিত পুরুষদের ব্যথা-বেদনা মা এবং স্ত্রীর অনুধাবনের বোধ হোক। সীমাহীন সীমাবদ্ধতার মধ্যে সবার সব চাওয়া পূরণ করা সামর্থ্যের বাইরে। স্ত্রীর কাছে যদি মনে হয় তার শ্বাশুড়ি খারাপ, তবে বিবেক দিয়ে ভাবা উচিত বৃদ্ধা আর কতদিন বাঁচবে? পুরুষ স্বভাবতই মায়ের অনেক আবদার মেনে নেয়। তবে সব মা যে ভালো, তা হলফ করে বলা যায় না। কেউ কেউ খারাপের সর্বনিকৃষ্টও হয়। পুরুষকে স্ত্রীর বাহুবন্ধনে ফিরতেই হবে। নারীরা পুরুষদের সামর্থ্য ও সক্ষমতা ভাবলে এবং সে অনুযায়ী কথা ও কাজ করলে শান্তি ফিরতো।
সুখের জন্য প্রত্যেককেই অল্প-বিস্তর ছাড় দিতে হবে। সবাইকে বাদ দিয়ে আমাকেই দাও, আমার কথা রাখতেই হবে—এভাবে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে সুখ-শান্তি নষ্ট হবে। মরে যাওয়া পলাশ সাহার বউ স্বর্ণ পাবে, মা সম্পদ পাবে; কিন্তু পলাশ সাহা জীবনটাকে আর ফিরে পাবে? থাকতে মূল্য দিন। না থাকলে সারাজীবন কাঁদতে হবে। অভিযোগ কমিয়ে, আশা ও আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবতার সাথে তাল মিলিয়ে মানুষকে অন্তত বাঁচতে দিন। লোভের মোহে হৃদয়হীন হবেন না।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন