যোগ্যরা যেনো অযোগ্যদের কাছে হেরে না যায়!

চাকুরি দেওয়া এবং পাওয়ার পথে দুর্নীতি করলে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটি হয় তা হচ্ছে একজন যোগ্য মানুষের সেবা থেকে রাষ্ট্র ও জনগণ বঞ্চিত হয়।

রাজু আহমেদ। কলাম লেখক। জিবি নিউজ ||

এক।

ব্যর্থ জীবনের যন্ত্রনা মেধাবী বেকার জানে! মাসের পর মাস দিনরাত্র একাকার করে পরিশ্রম করা চাকুরি প্রার্থীকে পরিবার-সমাজের কটুবাক্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। নিশ্চয়ই এটা কোন সুখকর ব্যাপার নয়! যখন কাঙ্ক্ষিত পরীক্ষা দিয়েও বাবরবার ব্যর্থ হতে হয় এবং পরিচিত একজন অ-পড়ুয়া কোন কথিত চ্যানেলে অর্থ ঢেলে কিংবা কোন ক্ষমতাকে ব্যবহার করে চাকুরিতে প্রবেশে চূড়ান্তভাবে সফল হয় তখন সেই পরিশ্রমী অথচ বাহ্যিকভাবে ব্যর্থের জীবন সামজিকভাবে উপহাসে পরিণত হয়। জীবনের এই পরিহাসের মোকাবেলা করে যারা টিকে গেছে তারা জানে এই যন্ত্রনার তিক্ততা কতোখানি! তখন সে প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। দেশে প্রতি রাগ-ক্ষোভ জন্মে। সে এখান থেকে মুক্তি পেতে বৈধ-অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমায়। 

 

সাম্প্রতিক সময়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার দ্বিতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে বিভিন্ন জেলায় ডিভাইসসহ বেশ কয়েকজন গ্রেফতার হয়েছে। একজন পার্লামেন্টারিয়ানের স্ত্রী’র পূর্বপক্ষের মেয়েও একই অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিল এবং তাকে যেকোন উপায়ে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে বা ছেড়ে দেওয়াও হয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, ভুল বোঝাবুঝি ছিল অথচ এই ভুল বোঝাবুঝিতে সবাইকে না ছেড়ে একজনকে ছেড়ে দেওয়ায় রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে কেউ কেউ! যা নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, পরীক্ষায় যারা অপরাধ করে আইনের আওতায় আসে শুধু সেই ক’জনই কেবল অপরাধের সাথে জড়িত? এর  অন্তরালে যে বিশাল সিন্ডিকেট জড়িত আছে সেটা ভেঙ্গে দেয়া না হলে মেধাবী ও যোগ্যরা বারবার বঞ্চিত হতেই থাকবে। ক্ষমতা ও অর্থের দৌরাত্ম্যে একজন যোগ্য প্রার্থীর স্থানে যদি একজন অযোগ্য প্রতিযোগী নিয়োগ পায় তবে সে তার প্রারম্ভের দুর্নীতিকে কায়েম করবে এবং বিনিয়োগের অর্থ আদায়ে মরিয়া হবে! নাগরিক ও রাষ্ট্র তার থেকে পরিপূর্ণ সেবা কখনোই পাবে না, আশা করাও ঠিক হবে না! 

গত বছরের শেষভাবে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রথম ধাপে যারা উত্তীর্ণ হয়েছে তাদের মধ্যে এমন একজন ছিল যিনি পরীক্ষার আগের রাতে গ্রেফতার হয়েছে অথচ উত্তীর্ণের তালিকায় তার নাম এসেছে। এ ঘটনাকে মিরাক্কল বলা চলে! সে ধাপের পরীক্ষাতেও জালিয়াতির অভিযোগে বিভিন্ন স্থানে গ্রেফতার হয়েছিল শতাধিক। জেলার সম্পূর্ণ পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা একবারে অনুষ্ঠিত হওয়ায় এমন এমন প্রতিষ্ঠানেও পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে যেখানের প্রত্যবেক্ষকদের এই জাতীয় পরীক্ষা গ্রহনের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না! প্রবেশপত্রের ছবির সাথে চেহারা মিলানোর বিষয়টিতে গুরুত্ব না থাকায় অসাধুরা অবৈধ সুযোগও গ্রহনের শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এছাড়া পূর্ব থেকে হল ম্যানেজ বা সেন্টার ম্যানেজের লুকোচুরি নতুন বিষয় নয়! তাছাড়াও যারা গ্রেফতার হয়েছে তাদের বাইরেও বৃহৎ একটি অংশ অপরাধের সাথে জড়িত থেকেও বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে পার পেয়ে গেছে। অভিজ্ঞতা বলছে, পিএসসি ছাড়া অন্যান্য ডিপার্টমেন্ট যে সকল পরীক্ষার আয়োজক হয় সেখানের উল্লেখযোগ্য সংখ্যার ব্যাপারেই বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। একবার এনএসআই এর মত গুরুত্বপূর্ণ ডিপার্টমেন্টের নিয়োগ পরীক্ষাতেও ফেইস ও সিগনেচার ডিটেক্টর দিয়ে বেশ কয়েকজন ভূয়া পরীক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। যারা অর্থের বিনিময়ে প্রক্সি দিতে এসেছিল! জেলা এবং বিভাগ ভিত্তিক নিয়োগগুলোতে মাঝে মাঝেই আর্থিক দুর্নীতির বিষয় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। 

 

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে বডি-চেইঞ্জ পরীক্ষা দেয়! চট্টগ্রাম কেন্দ্রে ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষাতেও প্রেমিকের পরীক্ষা দিতে এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক প্রেমিকা গ্রেফতার হয়েছে! সুতরাং নিয়োগে কখনো কখনো ছোট ছোট দুর্নীতি হচ্ছে আবার কখনো কখনো পুকুর চুরির মত ঘটনাও ঘটছে। গত কয়েক বছর পূর্বে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়োগে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি বাণিজ্য সংক্রান্ত সিরিজ রিপোর্ট প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়াও মেডিকেলসহ বিভিন্ন ভর্তি পরীক্ষায় দুর্নীতির বিষয়টি বারবার গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আশার কথা, কয়েকবছর আগেও যেভাবে অহরহ প্রশ্নফাঁস হতো সেটা অনেকটাই বন্ধ হয়েছে। তবে দুর্নীতি বন্ধ হয়নি। সেটা খোলস বদলেছে মাত্র। 

 

দুই।

চাকুরির জন্য সুপারিশের ধরণ চেইঞ্জ হয়েছে। আগে দুর্নীতিবাজরা প্যাকেজ প্রোগ্রামে চাকুরি দিতে পারতো! বর্তমান সরকারের কড়াকড়ি আরোপের কারণে সেটা বহুলাংশে বন্ধ হয়েছে। এখন কারো জন্য সুপারিশের নিম্নতম যোগ্যত লিখিততে উত্তীর্ণ হওয়া! দেশব্যাপী এ নিয়ে কয়েকটি সিন্ডিকেটও আছে বোধহয়! হয়তো কেউ কেউ একাই সিন্ডিকেট! এরা নিজ এলাকা এবং আশেপাশের চাকুরিপ্রার্থীদের খোঁজ খবর রাখে! কে, কোন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে সেটা তাদের নখদর্পণে থাকে! সরাসরি প্রার্থীর সাথে, প্রার্থীর পরিবারের সাথে এরা আর্থিক চুক্তি করে! যাদের টাকা আছে তারা এদেরকে প্রস্তাবিত অর্থ অথবা চেক প্রদান করে! এই টাকা নিয়ে এরা দফতরে দফতরে যায় কি-না সেটাও সন্দেহের! কেননা  অনেক জায়গাতেই উচ্চস্থানে এখনো সৎ মানুষেরা চেয়ারে আছেন! সেখানে প্রশ্রয় পাওয়ার কথা না।

 

আমার যা ধারণা, এই দুর্নীতিবাজ শ্রেণী চটকদার চটকদার কথা বলে বেশ কয়েকজনের টাকা নিয়ে চুপ করে বসে থাকে! এদের মধ্যে কারো না কারো চাকুরি তো এমনিতেই হয়। তাদের টাকা রেখে, বাকিদের টাকা ফেরত দিয়ে দেয়! সেখান থেকেও হয়তো কিছু খরচাপাতি রাখে! যারা টাকা ফেরত পায় তারা ভাবে, লোকটি এতো ভালো! এই টাকাও এতো সহজে ফেরত দেয়! এভাবে তার মার্কেটিং হয় এবং ব্যবসা বাড়ে! কিছু না করেও এই শ্রেণি রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয় এবং মানুষ এদের দ্বারা প্রভাবিত ও প্রতারিত হয়! কেন জানি মানুষ, মনে মনে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে! তবে আশার কথা, এরা যাদেরকে প্রতারিত করে তারাও ভবিষ্যতের দক্ষ প্রতারক হবে! একজন ঘুষ দিয়ে, দুর্নীতি করে চাকুরি পাবে আর সে তার কর্মকালে সেই টাকা কয়েকগুণ করে উসূল করবে না-সেটা শয়তানেও বিশ্বাস করবে না! 

 

চাকুরি দেওয়া এবং পাওয়ার পথে দুর্নীতি করলে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটি হয় তা হচ্ছে একজন যোগ্য মানুষের সেবা থেকে রাষ্ট্র ও জনগণ বঞ্চিত হয়। দ্বিতীয়ত, পরিশ্রমী ও মেধাবী ছেলেটির বঞ্চিত এবং দুর্নীতিবাজ সফল-সমাজে এমন দৃষ্টান্ত যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন সেটা সবার জন্যই খারাপ বার্তা বহন করে। তৃতীয়ত, অধিকার বঞ্চিত একজন মেধাবী যখন তার প্রাপ্য না পায় তখন তার মধ্যে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয় সেটা জাতীয়তাবোধ ও দেশপ্রেম সৃষ্টির বদলে ঘৃণার উদ্রেক করে। 

 

যে সকল উচ্চশিক্ষিত মেধাবীরা খেয়ে না খেয়ে, দিন-রাতের পার্থক্য ভুলে বছরের পর বছর চাকুরির চেষ্টায় লেগে আছে তাকে অনৈতিকভাবে বঞ্চিত করার চেয়ে ঘৃণিত ও ন্যাক্কারজনক কাজ আর একটাও নাই। একজন বেকারকে সমাজস্থরা কত তীর্যক কথা শোনায়, পরিবার কতভাবে নাজেহাল করে! রাষ্ট্রও যদি সেই একই কাজ করে তবে রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠত্ব থাকে না। অধিকার বঞ্চিত মানুষের চোখের পানির মূল্য আছে। তাদের ক্ষোভের ক্ষমতা আছে। চাকরির ক্ষেত্রটিকে যেকোন কঠিন পদক্ষেপ নিয়ে হলেও পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। যোগ্যরা উপযুক্ত চাকুরি পাবে-এমন স্লোগানের বাস্তবতার দ্বারাই স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব। অযোগ্যরা যোগ্যদের স্থান দখল করলে উন্নয়নের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেবে এবং সামাজিক অনাচার বাড়িয়ে তুলবে। রাষ্ট্রের সামগ্রিক দুর্নীতি হৃাস করতে হলে দুর্নীতিমুক্ত নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতেই হবে। 

 

 

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন