জিবিনিউজ 24 ডেস্ক//
মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ সেনা হতাহত আর রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে বেশি উদ্বেগ দেখাচ্ছে পশ্চিমা গণমাধ্যম আর তাদের সরকাররা। প্রায়ই মরা কান্না জুড়ে দিচ্ছে তারা। যদিও এসব ইস্যুতে টু শব্দটি করছে না মস্কো। বরং আরও বেশি আগ্রাসী ও পশ্চিমাদের ভালো মানুষীর মুখোশের সমালোচনায় মুখর ক্রেমলিন।
নিজের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক আধিপত্য বজায় রাখতে মরিয়া নীতি ঘোষণা করেছে মস্কো। এতে আপাত দৃষ্টিতে যে ক্ষতি হচ্ছে; তা বিকল্প উপায়ে সমাধানের চেষ্টা করছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। পুরোনো মিত্রদের পাশে রাখতে দিচ্ছেন নানা সুযোগ-সুবিধা। যা অন্তরজ্বালা বাড়িয়ে দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্রদের। গত সাড়ে চার মাসের বেশি সময় ধরে রাশিয়া সরাসরি সমরে থাকলেও, ইউক্রেন যুদ্ধের এই ভার আর বইতে পারছে না বিশ্ব। খাবার থেকে জ্বালানি সব কিছুর এখন অগ্নিমূল্য।
ব্লুমবার্গের হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে। যা নীরব দুর্ভিক্ষ ডেকে আনছে যুদ্ধবিধ্বস্ত বিভিন্ন দেশে। বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখাই কঠিন হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের। বাসা-বাড়ি আর কলকারখানায় গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে যোগান স্বল্পতায় হিমশিম অবস্থা তাদের। যার পরিণতি লোডশেডিং।
পাকিস্তানে দিন-রাত মিলিয়ে শহরে ৮ ঘণ্টা ও গ্রামে লোডশেডিং ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত ঠেকেছে। শ্রীলঙ্কার অবস্থা আরও খারাপ। স্বস্তিতে নেই ভারতও। কয়লার যোগান কম এবং বিশ্ববাজারে চাহিদা ও মূল্য ভয়াবহভাবে বেড়েছে। আর এতে ভারতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গ্রামাঞ্চলে দীর্ঘ সময় ধরে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। শহরেও বাসা-বাড়িতে আসা-যাওয়ার মধ্যে আছে বিদ্যুৎ। এমন পরিস্থিতিতে রাশিয়ার বন্ধুরা সস্তায় তেল-গ্যাস পাচ্ছে। যার সুবিধা নিয়েছে ভারতও।
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও একইরকম উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ছায়ায় বসে এই খেলা যে কতটা অনিরাপদ তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন তিনি। প্রথমে তার ওপর থেকে নেক নজর সরিয়ে নেয় দেশটির সেনাবাহিনী। পরে একজোট হয়ে হামলে পড়েন বিরোধী রাজনীতিকরা। গড়ে তোলেন নজিরবিহীন ঐক্য। নানা নাটকীয়তার পর ক্ষমতার মসনদে আসীন হন শাহবাজ শরীফ নেতৃত্বাধীন বিরোধীরা। কিন্তু যে পিচ্ছিল পথে তারা ক্ষমতায় এলেন, সেটি তাদের তা আরও খাদের কিনারায় নিয়ে গেছে।
আমদানি খরচ মেটানোর মতো দু’মাসেরও রিজার্ভ নেই দেশটির কাছে। যাতে দেউলিয়া শ্রীলঙ্কার ছায়া দেখতে পাচ্ছেন অনেকে। এখনকার অবস্থা চলতে থাকলে এই ছায়াই কায়া হয়ে উঠবে পাকিস্তানের। গেল মে মাসে ৪০ বছরের মধ্যে রেকর্ড ৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতি দেখেছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।
মার্কিন থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চের তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯১ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ২.৩ শতাংশ। মাত্র চারবার ৫ শতাংশ পেরিয়েছে এই হার। এখন তো তার চেয়েও প্রায় দ্বিগুণ। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে বাইডেন প্রশাসন। অগ্রসরমান অর্থনীতির ৪৪টি দেশের মূল্যস্ফীতির একটি তালিকা তৈরি করেছে পিউ রিসার্চ। যাতে দুই বছর আগের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় ২০২২ সালের প্রথম প্রান্তিকে গড়ে দ্বিগুণ মূল্যস্ফীতি দেখেছে বিশ্বের ৩৭টি দেশের মানুষ। এসব দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতি তুরস্কে। তবে বৃদ্ধির হারে সবার ওপরে আছে ইসরায়েল। ২০২০ সালের প্রথম প্রান্তিকে মূল্যস্ফীতি যেখানে ছিল মাত্র ০.১৩ শতাংশ; সেখানে ২০২২ সালে দেশটির মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৩.৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ মাত্র দুই বছরে ইসরায়েলের মূল্যস্ফীতি ২৫ গুণ বেড়েছে।
গ্রিস, ইতালি, স্পেন ও পর্তুগালের মতো দেশে জিনিসপত্রের দামের পাগলা ঘোড়া লাগামহীন। এমনকি দুই বছর আগেও যে সুইজারল্যান্ডে মাইনাস শূন্য দশমিক ১৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ছিল, সেটি এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ০৬ শতাংশে।
ইউরোপের গড় মূল্যস্ফীতির হার ৮.৬ শতাংশ। খাবার-দাবারের দাম দ্রুত বৃদ্ধিসহ জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি অর্থনীতিকে সঠিক পথে রাখতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকারেরই এখন গলদঘর্ম অবস্থা। এতে অসন্তোষ বাড়ছে জনমনে। দিকে দিকে শক্তিশালী হচ্ছে ঘৃণার সংস্কৃতি। যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয়তাবাদী ও শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বাদীদের ভুয়া তত্ত্ব ‘রিপ্লেসমেন্ট থিউরি’র জনপ্রিয়তা ভয়াবহ মাত্রায় বেড়েছে।
ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শেষ হাসি না হাসলেও সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচনে বেশ ভালো করেছে উগ্রবাদের প্রতি নরম ধারণা পোষণকারীরা। রাশিয়াকে খোলসবন্দি করতে সামরিক জোট ন্যাটোকে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অহেতুক রাজনীতির বলি হচ্ছেন বিশ্ববাসী। ট্রাম্প আমলে হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পেতে বাইডেন প্রশাসনের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতিই এখন তাদের গলার কাঁটা হয়েছে।
জ্বালানির দাম সহনীয় করতে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতকে তেলের উৎপাদন বাড়ানোর অনুরোধ করা হলেও তা আমলে নেয়নি দেশ দুটি। বরং এই সুযোগে নিজেদের ধন ভাণ্ডার আরও সমৃদ্ধ করছে তারা। যা দিয়ে উচ্চাভিলাষী বিভিন্ন খাতে খরচ বাড়িয়েছে।
মার্কিন পৌরহিত্যের দুর্বলতায় গোটা বিশ্বই কাঠামোগত বড় বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তাই ইউক্রেন যুদ্ধ দ্রুত শেষের আশায় তীর্থের কাকের মতো চেয়ে আছে পশ্চিমারা। এতে কয়েকদিন পরপরই তাদের তাত্ত্বিকরা যুদ্ধের পরিসমাপ্তির নানা সমীকরণ নিয়ে হাজির হচ্ছেন। যা ফলাও করে প্রচার করছে পশ্চিমা গণমাধ্যম।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন