শরীরের আকর্ষণ সাময়িক। একটা সময় থামতে হয়। কিন্তু মনের ব্যাপ্তি মৃত্যু অবধি
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।
বুড়ো বাম! ৩৩ বছরে চাকরি পাওয়ার পর ১৭ বছরের পাত্রী খোঁজে! বন্ধুদের আড্ডায় মশকরা করে বলে, কচি লাগবে!
বিয়ের ক্ষেত্রে বয়সের এই অসম ব্যবধান সমাজকে যে কতটা ভোগাচ্ছে, তার অনেকটা বাইরে থেকে আন্দাজ করা যায় না। দুর্ঘটনা সামনে এলে তবেই ঘটনা বুঝতে পারি! শরীর শরীরকে ধারণ করতে পারলেও, মন এই ব্যবধানকে রীতিমতো বারণ করে। কথা বলার জন্য কিংবা খুনসুটিতে ঝগড়াঝাঁটি, চুলোচুলি এমনকি মারামারি করার জন্য হলেও অন্তত কাছাকাছি বয়সের দুজন মানুষের পরস্পরের সঙ্গী হওয়া উচিত! বিবাহে জেনারেশন গ্যাপ অশান্তির বড় কারণ। একেক প্রজন্ম একেক রকমের ধ্যানধারণা নিয়ে বেড়ে ওঠে।
আগে নানার বয়সে নাতির বয়সীকে বিয়ে করতো—তখন সেটা মানাতো। নারী তো তখন কথা বলতে জানতো না, মতামত দিতে পারতো না। এখনকার নারী চুপ থাকবে? তাকে কিছু চাপিয়ে দিয়ে দমিয়ে রাখা যাবে?
অষ্টাদশী প্রতিদিন ঘুরতে ইচ্ছা করবে, একক পরিবারে থাকতে ইচ্ছা করবে এবং স্বামীর সবকিছু দখল করতে ইচ্ছা করবে! ৩০-৩২ বছরের পুরুষ তো প্রায় বৃদ্ধ মানুষের মতো চিন্তা করবে। কাজেই দুজনের চিন্তায় যে দূরত্ব, তা তাদের পরস্পরের মন থেকেও বহুদূরে নিয়ে যায়। তখন হয় স্বামীকে, নয়তো স্ত্রীকে অনেকখানি স্বৈরাচারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। আজকাল পর সামলানোর চেয়ে ঘর সামলানো কঠিন।
বিয়ের ক্ষেত্রে বয়স অবশ্যই ফ্যাক্টর। অতীতে মায়েদের দুর্বল করে রাখার অস্ত্রই ছিল সিরিজ সন্তান গ্রহণ করিয়ে দেওয়া। এ যুগে বড়জোর দুইটি! সমাজ যেভাবে হাঁটছে, তাতে এই দুটোতেই আবার একটি বেশি! বিবাহে স্বামী-স্ত্রীর বয়সের ব্যবধান যদি বেশি হয়, তবে ভবিষ্যতে বহুমাত্রিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। সাধারণত চাকরিজীবী, প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিবাহ করা পুরুষ এবং প্রবাসীদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য অধিক হয়! অশান্তি অনেকটাতে সমাজের এই আঙিনা পুড়ছে।
ধরা যাক, স্বামীর সাথে স্ত্রীর বয়সের ব্যবধান পনেরো বছর! স্ত্রী যখন পঁচিশে, স্বামী তখন চল্লিশের কোঠায়! স্বামীর চালশে দেখার বয়সে স্ত্রীর দেখার কেবল শুরু! তাছাড়া খাদ্যাভ্যাস এবং প্রকৃতিগতভাবেই আজকাল পুরুষের শারীরিক শক্তি-সামর্থ্যের যা হাল! পুরুষের নেতিয়ে পড়ার বয়সে নারীর যে জেগে ওঠার কাল!
দাম্পত্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মনের মিল। অসম সময়ে সৃষ্ট দুজনার মন সরল রেখায় চলবে—এটা ভাবছেন কী করে? বিবাহে বয়সের ফারাক অনেক হলে স্বামী কোনোদিন স্ত্রী’র মনের নাগাল পায় না আর স্বামীর প্রতি স্ত্রীরও অভিযোগের পাহাড় জমতে থাকে।
শরীরের আকর্ষণ সাময়িক। একটা সময় থামতে হয়। কিন্তু মনের ব্যাপ্তি মৃত্যু অবধি। সাংসারিক অশান্তির অনেকগুলো কারণের মধ্যে বয়সের ব্যবধান অন্যতম প্রধান ফ্যাক্টর। বিবাহের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের শারীরিক সক্ষমতা, ভৌগোলিক প্রবণতা এবং সামাজিক সুস্থ ধারা বজায় রাখতে বৈজ্ঞানিক নিয়মনীতি মানা উচিত। ব্যবধান বড়জোর ছয়। নয়তো জীবন নয়-ছয়ে হ-য-ব-র-ল হয়ে যাবে।
সাম্প্রতিক আত্মহত্যা করা পলাশ সাহার সংসারের অশান্তিতেও অসম বয়সের প্রভাব ছিল। একজন মানুষ তার সঙ্গীকে বুঝবে, অনুপস্থিতিতে খুঁজবে—এর জন্য বয়সের পরিপক্বতার উপযুক্ততা দরকার। দুজনের মন যদি দুনিয়ার দুদিকে হাঁটে, তবে হাটবাজারে দুএকবার মিলন হতে পারে, কিন্তু সুখ স্থায়ী হয় না।
বিবাহের ক্ষেত্রে প্রাচীন প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসা জরুরি। দুজনের একসাথে তরুণ থাকা, যুবক হওয়া এবং বৃদ্ধ বয়সে হাঁটা জরুরি। একজন বৃদ্ধ হবে আরেকজন যুবতী থাকবে, তাও পরস্পরের বিশ্বাস পাহারা দিয়ে রাখবে—সেই আলোর অনেকটাই এই দুনিয়ায় পড়ে না। কাজেই বিবাহের সিদ্ধান্তের পূর্বে বাস্তববাদী হোন। শুধু বর-কনে নয়, বরং উভয়ের বাবা-মা ও অভিভাবকদেরকেও এ ব্যাপারে সচেতন ও সজাগ থাকতে হবে।
সঙ্গীর কথার ওজন, চিন্তার গভীরতা বইতে পারা জরুরি। কিছু নারী অর্থের লোভে পড়ে। তবে হতাশাতেও ভুগতে হয় বটে!

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন