স্মৃতির মুখচ্ছবি বাংলা নববর্ষ ও বহুবৈচিত্রের ঐতিহ্যের মেলা

gbn

দে লো য়া র  জা হি দ ||


অনাগত দূরভবিষ্যে বাঙালি জনগোষ্ঠী, বঙ্গভাষাভাষী ও তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারা বিশ্বসংস্কৃতিতে কোথায় স্থান করে নিবে তা এখনি ভেবে দেখার সময় এসেছে।  বাঙালির ইতিহাস নিজেদের ভাষা ও আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ করে বিজয়ী হওয়ার এক মহান ইতিহাস। ১৯৭১ সালে এ জনগোষ্ঠী একটি  ভিন্নরাষ্ট্র থেকে আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়েছিল। ভাষা ও সংস্কৃতির ঐক্যবন্ধনে আবদ্ব হয়ে একটি পৃথক  রাষ্ট্র গঠন করেছিল, যার নাম বাংলাদেশ। আবেগহীন পক্ষপাতশূন্য ও নির্বিকল্প ধর্মনিরপেক্ষ  একটি দেশের প্রতিশ্রুতি ছিলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূলচেতনা। আমাদের সুপ্রাচীন ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার এখন তা বিশ্বসংস্কৃতির অংশ। বাংলাদেশের একটি জনগোষ্ঠী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।  তাদের মাধ্যমে বহুবৈচিত্রের এসকল ঐতিহ্যের মাঝে বাংলা নববর্ষ, একুশে ফেব্রুয়ারী সহ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের অনেকগুলো বিষয় ইউরোপ, আমেরিকায় আলোচিত হয়ে উঠেছে।

বহুবৈচিত্র এ মেলা উদযাপনে বাংলাদেশকে গর্বিতভাবে উপস্থাপনের সুখ ও আনন্দ আমার মনকে আপ্লুত করে. বাংলাদেশ যে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ও স্থান করে নিতে পারে, এবং স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো তাদের দূরদর্শিতায়  মতবিরোধ ভুলে অনন্য সব উদহারন সৃষ্টি করতে পারে- তা দেখিয়েছে এ বাংলা নববর্ষ তথা বৈশাখী মেলা ও আমাদের  "হেরিটেজ ফেস্টিভাল"। প্রবাসে বাংলাদেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে প্রতিবছর আলবার্টায় বৈশাখী মেলার আয়োজন করে বাংলাদেশ হেরিটেজ এন্ড এথনিক সোসাইটি  অব  আলবার্টা, বাংলাদেশ-কানাডা এসোসিয়েশন অব এডমন্টন, ডাইভার্স এডমন্টন ও অন্যান্য সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন । বাংলাদেশ ফেস্টিভ্যাল বা বৈশাখী মেলার আয়োজনে ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে সংগঠনগুলোর প্রস্তুতি। বর্ণাঢ্য এসব আয়োজনে থাকছে দেশ ও প্রবাসের স্বনামধন্য শিল্পীদের ও স্থানীয় শিল্পীদের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা, থাকছে স্টল, রকমারী ও বাহারি সব দেশজ পণ্যের সমাহার।

এডমন্টন হেরিটেজ ফেস্টিভ্যাল, হাওরেলাক পার্ক অনুষ্টিত হয়ে আসছে প্রতিবছর যা এবার ৩০ জুলাই-১লা আগস্ট, ২০২২  অনুষ্ঠিত হবে. আলবার্টা প্রাদেশিক সরকারের প্রতিনিধিসহ বাঙ্গালী কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এ সব ফেস্টিভ্যাল বা মেলায় অংশগ্রহণ করেন, অংশগ্রহণ করেন পরিবার পরিজন নিয়ে প্রবাসী পেশাজীবি সম্প্রদায় ও কানাডার উৎসাহী মানুষজন । ফেস্টিভ্যালে বাংলাদেশকে আরো  জনপ্রিয় ও সফল করে তুলতে সকল প্রবাসী বাঙ্গালীদেরই সহযোগিতা প্রয়োজন।

দক্ষিণ আফ্রিকার শিকড়, তাদের সমৃদ্ধ, প্রাণবন্ত এবং বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি উদযাপন করে ২৪শে সেপ্টেম্বর-হেরিটেজ ডে যা হল একটি উল্লেখযোগ্য দিন।   মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে অনুষ্ঠিত প্রায় ১০০টি সঙ্গীত উৎসবের একটিকে বোঝায় যেখানে মিডল স্কুল এবং হাইস্কুল-বয়সী বাদ্যযন্ত্রের সমাহার বিচার করা হয়। একটি জাতীয় মানের দলগুলোর মধ্যে গায়কদল, ব্যান্ড এবং অর্কেস্ট্রা অন্তর্ভুক্ত থাকে । ঐতিহ্য দিবস তাদের জাতির সাংস্কৃতিক সম্পদকে স্বীকৃতি দেয় এবং উদযাপন করে। দক্ষিণ আফ্রিকানরা এমন অনেক সংস্কৃতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে স্মরণ করে ও দিনটি উদযাপন করে।

জার্মানির কতগুলো উত্সব রয়েছে যেখানে অক্টোবর ফেস্ট,(মিউনিখ), ডিএফবি পোকাল (বার্লিন), কার্নিভাল (কোলন) রিপারবাহন, (হামবুর্গ) ইত্যাদি। দু’ হাজার দুই সালের নভেম্বরের কথা। স্পেনের ভিগো থেকে মাদ্রিদ হয়ে টরন্টো এসেছি । চারিদিকে স্নো পড়ে যোগাযোগ  বিপর্যস্থ প্রায়। নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে রয়েছি বাইরে। স্মৃতিতে ভাসছে ইউরোপের ৭টি বছর, স্বদেশের ব্যস্ততম জীবন, আর দেশত্যাগী হৃদয়ের শেকড় উপরানো  যন্ত্রনা। ভাসছে নেদারল্যান্ডস, ব্রাসেলস, জার্মান ও স্পেনের ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতি। বিশেষতঃ স্পেনের বড় বড় মেলা ঘুরে দেখার স্মৃতি। ভ্যালেন্সিয়ায় টমেটো ফেলা থেকে শুরু করে আরিজকুনে বনফায়ারে ঝাঁপ দেওয়া পর্যন্ত, তালিকায় যোগ করার জন্য এখানে সেরা সব স্প্যানিশ উৎসব রয়েছে। যার মধ্যে থ্রি কিংস ডে (ফিয়েস্তা দে লস রেয়েস), (দেশব্যাপী), অল সেইন্টস ডে (ডিয়া দে টোডোস লস সান্তোস)(কাডিজ), পবিত্র সপ্তাহ (সেমানা সান্তা) হল স্প্যানিশ ছুটির ক্যালেন্ডারের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। ইস্টার সানডে পর্যন্ত সাত দিনের মধ্যে পুরো স্পেন জুড়ে ইস্টার উৎসব হয়। যাহোক, সবচেয়ে বড় দর্শন হল সেভিলে যেখানে মেরি এবং যিশুর রত্নখচিত মূর্তি বহন করে বিস্তৃত ভাসমান মিছিলের একটি সিরিজ রাস্তায় নেমে আসে; সূক্ষ্ম হুড, এবং পিতলের ব্যান্ড পরা অনুতাপের পাশাপাশি। প্রতি বছর, শহরটি কিভাবে দর্শক এবং স্থানীয়দের দ্বারা পরিপূর্ণ হয় অভিজ্ঞতাটি মূল্যবান। পবিত্র নিরপরাধ দিবস প্রতি ২৮শে ডিসেম্বর, এপ্রিল ফুল দিবসের সমতুল্য স্প্যানিশ মানুষকে পাগলামি করার জন্য একটি অজুহাত দেয়, যেমন ব্যবহারিক জোকস খেলা এবং স্পুফ গল্প বলা। ফিয়েস্তা দে লা মার্সে, (বার্সেলোনা) সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে, বার্সেলোনা শহরের পৃষ্ঠপোষক সন্ত আওয়ার লেডি অফ মার্সি (লা মার্সি) এর সম্মানে তার বৃহত্তম স্ট্রিট পার্টি, ফিয়েস্তা দে লা মার্সে আয়োজন করে। ফ্রি মিউজিক কনসার্টগুলো প্লাজা গুলোতে (বিশেষ করে প্লাসা দে কাতালুনিয়া এবং প্লাসা শান্ট জাউমে) হয় এবং লোককাহিনীর চিত্র যেমন দৈত্য (দৈত্য) এবং ক্যাপ গ্রোস (ফ্যাথেডস) রাস্তায় নেমে আসে। লোকেরা সারদানা (ঐতিহ্যবাহী কাতালান নৃত্য) পরিবেশন করতে এবং পেরেক কামড়ানো (মানব টাওয়ার) দেখতে বাইরে আসে। রাত নামার সাথে সাথে, আতশবাজি আকাশকে আলোকিত করে, চুল-উত্থানের দ্বারা একটি উন্মুক্ত-বায়ু পারফরম্যান্সে পরিণত হয়।

ইউরোপের এক স্বপ্নপূরী- নেদারল্যান্ডস। দুবাই,  ওয়ার্সঅ হয়ে আমষ্টারডাম বিমানবন্দরে এসে নামলাম ’৯৫ সালের মাঝামাঝি। সেছিলো এক বিচিত্র অনুভুতি। ট্রেন চেপে এলাম ব্রাসেলসে। স্বদেশ ছেড়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনের প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ যেন হৃদয়কে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে। এদিক ওদিক ঘুরে  বেড়ালাম দু’দিন। বেশ ভালই লেগেছে ব্রাসেলস। তারপর জার্মানে…। ইউরোপে মাইগ্রশানের তিক্ত স্মৃতির বেদনা নিয়ে পাড়ি জমালাম কানাডায়। পরিবার, পরিজন রয়ে গেলো স্পেনের গালিসিয়ায়। এ জীবনে নির্জনতা, একাকীত্ব  নতুন কিছু নয়। মনে পড়ে জার্মানের দক্ষিন পশ্চিম সীমান্তের ছোট্র  শহর- ফ্রাইবুর্গের কথা। শহরের পশ্চিমে বয়ে গেছে ড্রাইসেম নদী, কিনারায় ব্ল্যাক ফরেষ্ট। এক হাজার ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ রেইন নদী যা বয়ে গেছে জার্মান, ইটালী, অষ্ট্রিয়া, লিসটেন ষ্টাইন, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ড  পর্যন্ত । স্মৃতিপটে এখনো ভেসে উঠে জার্মান ও স্পেনের সব আনন্দমেলা গুলোর কথা। হৃদয়ে সাত শত নদ-নদীতে ঘেরা বাংলাদেশ। যেখানে রয়েছে ঘাত, প্রতিঘাত জীবন চলার পথে তবুও স্বপ্ন, ছুটে চলে জীবনের উল্টো রথে।

এসব বহুবৈচিত্র ও  সংস্কৃতির মেলায় বাঙালি সংস্কৃতিকে তুলে ধরায় বাইরের প্রতিকূলতা থেকে ভিতরের প্রতিকূলতা অনেক বেশি। বাংলাদেশ পেভিলিয়নে থাকে নজরকাড়া মানুষের ভীড়। খাবারের প্রতি আসক্তি, পোষাক, জুয়েলারী, কারুকাজের প্রতি থাকে কানাডিয়ানদের আগ্রহ। যেমন এবছর বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন তথা একুশে ফেব্রুয়ারী প্রবাসী বাঙালির জীবনে এক স্মরণীয়  অধ্যায় হয়ে থাকবে। একুশে আমাদের গ্লানি আর আত্নপ্রবঞ্চণা বিমোচনের দিন, একুশে আমাদের স্বাতন্ত্রবোধকে জাগ্রত করার একটি দিন., সেদিন যাদের অসামান্য অবদানের জন্য আমরা আজ  মাতৃভাষা (বাংলা)য় লিখছি, বলছি, প্রাণ খুলে হাসছি, আলোচনায় মাতছি, তাদেরকে স্বশ্রদ্ধ সালাম। একুশের  ভাষা আন্দোলনে, স্বাধিকার রক্ষার লড়াইয়ে, অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন যে সকল ভাষাসংগ্রামী। অনেক অনেক বিস্তৃত ছিল তাদের কাজের পরিধি। ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে সফলতা তুলে আনতে বিশ্বব্যাপী প্রবাসী বাঙালিরা আজো উৎসাহিত ও নিবেদিত প্রান।

বঙ্গভাষাভাষী এ জনগোষ্ঠী ধর্মের দিক থেকে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ও  সম্প্রদায়ের দিক থেকে শিয়া-সুন্নি--বাউল-হীনযানী-মহাযানী-ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-শূদ্র-বৈষ্ণব-ক্যাথলিক বা প্রোটেস্ট্যান্ট যা'ই হই না কেন  ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিচয় আমাদের একটি তা হলো  আমরা বাঙালী কানাডার মতো বহুসংস্কৃতির মাঝে যা স্থান করে নিয়েছে। সুপ্রাচীন ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারগত  'বাংলাদেশ'কে যারা কোনো লেবাস পরাতে চান তাদেরকে শুধু কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সে পংথিগুলো স্মরণ করিয়ে দেবো।..

"নাস্তিক সেও পায় বিধাতার বর,
ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর।
শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো,
শাস্ত্র মানে না, মানে মানুষের ভালো।

মানুষের ভালো কামনায় বাঙালি সংস্কৃতির অন্যান্য মোটিফ সমন্বিত শোভাযাত্রা তথা পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা, বাঙালির হৃদয়ের কাছাকাছি একটি উত্সব, ইউনেস্কোর মতে মানবতার অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিনিধি তালিকায় রয়েছে আমাদের এ সংস্কৃতি যা এখন বিশ্ব জয়ের অপেক্ষায়।

লেখক : দেলোয়ার জাহিদ, সাবেক রিসার্চ ফ্যাকাল্টি মেম্বার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবা, (সেন্ট পলস কলেজ) কানাডা, জন হাওয়ার্ড সোসাইটি অফ ম্যানিটোবা, সাবেক বোর্ড অব ডিরেক্টরস মেম্বার প্রাবন্ধিক ও রেড ডিয়ার (আলবার্টা) নিবাসী।

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন