আফগান পরিস্থিতি: ধর্মের নামে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী নাগরিক প্রতিরোধ

আনসার আহমেদ উল্লাহ

 

গত ৫ সেপ্টেম্বর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উদ্যোগে আফগান সংকট সম্পর্কে এক অনলাইন আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সংগঠনের সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনের বিষয় ছিল: ‘আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতাদখল: সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিরোধের আহ্বান।’

 

সম্মেলনে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, তুরস্ক, উজবেকিস্তান, মিশর, ঘানা, লাইবেরিয়া, ইথিওপিয়া, সিয়েরা লিওন, মেসিডোনিয়া, রাশিয়া, পোল্যাণ্ড, ক্রোয়েশিয়া, সুইজারল্যাণ্ড, ফ্রান্স, নেদারল্যাণ্ড, বেলজিয়াম, সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যাণ্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রাজিল, জামাইকা, জাপান, আর্জেন্টিনা ও অস্ট্রেলিয়ার তিন শতাধিক শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, আইনপ্রণেতা, কূটনীতিক, রাজনীতিবিদ, মানবাধিকার কর্মী, শান্তিকর্মী ও উন্নয়নকর্মী উপস্থিত ছিলেন।

 

সম্মেলনের সূচনাপর্বে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী আফগান মানবাধিকার নেত্রী বিশিষ্ট আইনজীবী কোবরা মোরাদি ছয় মহাদেশের ১০৭জন বিশিষ্ট নাগরিক কর্তৃক স্বাক্ষরিত খসড়া ঘোষণা ও প্রস্তাব উত্থাপন করেন, যা বিস্তারিত আলোচনার পর গৃহীত হয়। এই প্রস্তাব জাতিসংঘ এবং এর সকল অঙ্গ সংস্থাকে প্রেরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে তালেবান সহ সকল জঙ্গি মৌলবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী নাগরিক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার অঙ্গিকার সম্মেলনে ব্যক্ত করা হয়।

 

সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী পাকিস্তানি মানবাধিকার নেত্রী তাহেরা আবদুল্লাহর প্রস্তাব অনুযায়ী সম্মেলনে গৃহীত ঐতিহাসিক প্রস্তাবের সপক্ষে বিশ্বব্যাপী ১০ লক্ষ গণস্বাক্ষর সংগ্রহের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

 

সম্মেলনে অন্যান্য বক্তা ছিলেন আফগান ইন্টেলেকচুয়ালস গ্লোবাল কমিউনিটিএর প্রেসিডেন্ট মানবাধিকার নেতা ও লেখক শাহী সাদাত, বেলজিয়ামের সাউথ এশিয়া ডেমোক্রেটিক ফোরাম-এর নির্বাহী পরিচালক ও প্রাক্তন এমইপি পর্তুগিজ রাজনীতিবিদ পাওলো কাসাকা, ভারতের ডেইলি পাইওনিয়ার-এর উপদেষ্টা সম্পাদক লেখক সাংবাদিক হিরন্ময় কার্লেকার, যুক্তরাষ্ট্রের ইরানি নারী অধিকার কর্মী সাংবাদিক বানাফসে যানদ, সুইডেনের ইউনাইটেড নেশনস অ্যাসোসিয়েশন-এর মানবাধিকার নেত্রী এ্যাটর্নি মোনা স্ট্রিন্ডবার্গ, সুইস ইন্টার-স্ট্রাটেজি গ্রুপ-এর কম্যুনিকেশনস-এর ডিরেক্টর নিরাপত্তা বিশ্লেষক ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন, পাকিস্তানের নারী অধিকার ও শান্তি কর্মী, “তেহরিক-ই-নিশওয়ান”-এর সভাপতি ধ্রুপদী নৃত্যশিল্পী সীমা কেরমানি, তুরস্কের আর্থ সিভিলাইজেশন প্রজেক্ট-এর প্রতিষ্ঠাতা, কবি ও নাট্যকার তারিক গুনারসেল, ফ্রান্সের খাইবার ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ-এর সভাপতি মানবাধিকার নেতা, লেখক সাংবাদিক ফজল উর রহমান আফ্রিদি, যুক্তরাজ্যের ওয়ার্ল্ড সিন্ধি কংগ্রেস-এর সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার নেতা ড. লাকুমাল লুহানা, তুরস্কের ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ থিয়েটার ক্রিটিক-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট বিশিষ্ট লেখক ও নারী অধিকার নেত্রী জেনেপ ওরাল, ফোরাম ফর সেকুলার নেপাল-এর সভাপতি রাষ্ট্রদূত যুবনাথ লামসাল, ফোরাম ফর সেকুলার ইজিপ্ট এ্যান্ড মিডল ইস্ট-এর সভাপতি লেখক সাংবাদিক মহসিন আরিশি, আফ্রো-এশিয়ান পিপলস সলিডারিটি অর্গানাইজেশন-এর প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল শ্রীলঙ্কার মানবাধিকার নেতা আরিয়াদাসা বিদ্যাসেকেরা, ঘানার মানবাধিকার নেত্রী সাংবাদিক মারিয়াম ইয়াং, উজবেকিস্তানের উইঘুর মানবাধিকার কর্মী সাংবাদিক সাবো কোসিমোভা, পাকিস্তানের মানবাধিকার নেত্রী তাহেরা আবদুল্লাহ প্রমুখ।

 

সভাপতির ভাষণে শাহরিয়ার কবির সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিশ্বের বিশিষ্টজনদের স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘আফগানিস্তানে বৈধ সরকারকে অবৈধভাবে অপসারণ করে জঙ্গি মৌলবাদী সন্ত্রাসী তালেবানরা যেভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে তার বিরুদ্ধে বিশ্বের সকল বিবেকবান মানুষ আজ সোচ্চার। আমরা অতীতে আফগানিস্তানে একই পন্থায় তালেবানদের ক্ষমতাদখল এবং পাঁচ বছরের নারকীয় শাসনকাল দেখেছি; যেখানে ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, জাতিসত্তা নির্বিশেষে আফগানদের উপর সীমাহীন দুর্যোগ নেমে এসেছিল। দক্ষিণ এশিয়া সহ গোটা পৃথিবীতে পাকিস্তান, আমেরিকা ও সৌদি আরবের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় তালেবানরা গত তিন দশক ধরে যে ভাবে জঙ্গি মৌলবাদী সন্ত্রাস রফতানি করেছে, তার মাশুল আজও আমাদের দিতে হচ্ছে। বিশেষভাবে মুসলমান প্রধান দেশগুলোতে গত পঁচিশ বছরে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির মৌলবাদীকরণ ও তালেবানিকরণ আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আফগানিস্তানে তালেবানদের সাম্প্রতিক উত্থানে এসব দেশের মৌলবাদী ধর্মব্যবসায়ীদের উল্লাসে আমরা উদ্বিগ্ন। বিশ্বের সর্বত্র মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করতে হলে এবং সভ্যতার বোধ ও বিশ্বশান্তি নিশ্চিত করতে হলে দেশে দেশে ধর্ম, বর্ণ ও জাতিসত্তার নামে উগ্রতা, সন্ত্রাস ও হত্যার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ নাগরিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।’

 

সম্মেলনে প্রস্তাব উত্থাপনকালে আফগান-অস্ট্রেলিয়ান মানবাধিকার নেত্রী কোবরা মোরাদি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিশেষত শান্তি এবং মানবাধিকার কর্মীদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষকে রক্ষা করা। আফগানিস্তানে উদ্ভূত সংকটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পদক্ষেপ সমগ্র আফগান জাতির ভবিষ্যৎ এবং ৩.৮ কোটি আফগান জনগণের জীবন-জীবিকাকে প্রভাবিত করবে। লিঙ্গ, বয়স, জাতি এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেক আফগানদের অধিকার এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আমাদের সবকিছুই করতে হবে। তালেবানের একচেটিয়া শাসন ব্যবস্থা মানবাধিকার এবং আইনের শাসনকে সম্মান করে না। এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত তাদেরকে ধিক্কার জানানো এবং স্বীকৃতি না দেয়া।’

 

সম্মেলনের প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে আফগানিস্তানের ভুক্তভোগী মানুষের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রাক্তন সদস্য মানবাধিকার নেতা পাওলো কাসাকা বলেন, ‘যারা সার্বজনীন মানবিক মূল্যবোধ, স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে তাদের সবাইকে অবশ্যই আফগান জনগণের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে হবে এবং যারা দেশটিকে তালেবানের হাতে তুলে দিতে চায় তাদের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করতে হবে। ধর্মান্ধ তালেবান শাসকরা তাদের দেশের জনগণের জন্য তো বটেই সমগ্র বিশ্বের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

 

ব্রিটিশ নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন বলেন, ‘আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা এবং ন্যাটো চলে যাবার পর ভারতকে নতুন একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হচ্ছে। যখন নিরাশাবাদীরা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের দিকে চেয়ে ছিল তখন পাকিস্তান আফগানিস্তানের জঙ্গিবাদের তত্ত্বাবধায়ক হয়ে ওঠে। পাকিস্তান তখন তাদের মৌলবাদী জঙ্গিদের সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছিল। পাকিস্তান সর্বদা প্রতিরক্ষার পরিবর্তে আক্রমণ করার চেষ্টা করছে। এতকিছুর পর তালেবান এবং পাকিস্তান জঙ্গিবাদ ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে এমনটা চিন্তা করা বোকামী ছাড়া কিছুই হতে পারে না।’

 

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন