সহিদুল আলম স্বপন || সুইজারল্যান্ড ||
সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) সাম্প্রতিক তিয়ানঝিন সম্মেলন দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক অঙ্গনকে নতুন আলোচনায় এনে দিয়েছে। চীন দীর্ঘদিন ধরেই এই সংগঠনের মাধ্যমে মধ্য এশিয়া থেকে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। অন্যদিকে, ভারত সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে যোগদানের পর থেকে নিজস্ব কণ্ঠস্বর তুলে ধরছে। প্রশ্ন এখন—এসসিও সম্মেলনের পর ভারত কি সত্যিই চীনের নেতৃত্ব স্বীকার করে নিচ্ছে, নাকি শুধুই কৌশলগত সমঝোতার অংশ নিচ্ছে?
ভারতের অবস্থান: সহযোগিতার ইঙ্গিত, নেতৃত্ব নয়
সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বেশ কিছু উষ্ণ বার্তা দিয়েছেন। তিনি চীনকে “উন্নয়ন অংশীদার” হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন যে ভারত ও চীন প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং সমান্তরাল উন্নয়নের দুই অংশীদার। এই বক্তব্যের মাধ্যমে দিল্লি বার্তা দিয়েছে যে সীমান্ত উত্তেজনা কিংবা রাজনৈতিক মতবিরোধ সত্ত্বেও ভারত চীনের সঙ্গে সহযোগিতার পথ খোলা রাখতে চায়। কিন্তু সহযোগিতা মানে নেতৃত্ব মান্য করা নয়। ভারত স্পষ্ট করে দিয়েছে, যে কোনো অংশীদারিত্ব “কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন”-এর ভিত্তিতে হবে।
সীমাবদ্ধতার বাস্তবতা
যেখানে ভারতের স্বার্থ প্রশ্নে আসে, সেখানে দিল্লি চীনের পথ মেনে নেয়নি। উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রতিক এসসিও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের বৈঠকে ভারতের প্রতিনিধি একটি যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেনি, কারণ সেখানে পাকিস্তানকে পরোক্ষভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছিল এবং কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের অবস্থানকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এটি প্রমাণ করে দিল্লি চীনের নেতৃত্ব মান্য করতে প্রস্তুত নয় যদি তা ভারতের নিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন করে।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চাপ
ভারতের ভেতরে চীনের প্রতি আস্থা খুব সীমিত। গালওয়ান সংঘর্ষের পর চীনবিরোধী মনোভাব সাধারণ মানুষের মনে দাগ কেটেছে। শাসক বিজেপিও চীনকে পুরোপুরি গ্রহণ করলে রাজনৈতিক ঝুঁকিতে পড়তে পারে। তাই মোদী সরকার কৌশলগতভাবে সম্পর্ক উন্নতির চেষ্টা করছে, কিন্তু দেশের ভেতরে সমর্থন ধরে রাখার জন্য চীনের নেতৃত্ব মান্য করার মতো পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকছে।
অর্থনৈতিক বাস্তবতা
ভারতের জন্য চীন একটি অপরিহার্য বাণিজ্য অংশীদার। বিশাল ট্রেড ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও চীনের প্রযুক্তি ও বাজার ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মোদী সরকার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে আগ্রহী, তবে একই সঙ্গে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নীতির মাধ্যমে অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা কমাতে চায়। তাই অর্থনীতির দিক থেকেও ভারত চীনের প্রভাব মেনে নেয়, কিন্তু সম্পূর্ণ নেতৃত্ব স্বীকার করে না।
চীনের কৌশল: আঞ্চলিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা
চীন এসসিও ব্যবহার করছে আঞ্চলিক নেতৃত্ব প্রমাণ করার মঞ্চ হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা কাঠামোর বিকল্প একটি ‘বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থা’ গড়ার লক্ষ্যে চীন রাশিয়ার সঙ্গে মিলিত হয়ে এসসিও-কে কাজে লাগাচ্ছে। ভারতকে এই পরিসরে টেনে আনা চীনের কৌশলের অংশ, যাতে দিল্লিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দূরে রাখা যায়। কিন্তু ভারত এখনও কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখতে চাইছে।
ভারত-মার্কিন সম্পর্কের প্রভাব
ভারতের জন্য যুক্তরাষ্ট্র একটি অপরিহার্য কৌশলগত অংশীদার, বিশেষ করে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে। কোয়াড জোটে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারতের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রমাণ করে দিল্লি পশ্চিমা শক্তিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করছে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ থাকা সত্ত্বেও ভারত চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে রাজি নয়। এই দ্বৈত ভারসাম্য নীতি হলো ভারতের দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক ঐতিহ্য—“কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন।”
এসসিও সম্মেলনের পর ভারতের কূটনৈতিক অবস্থান আরও স্পষ্ট: ভারত চীনের নেতৃত্ব পুরোপুরি মান্য করছে না। বরং, দিল্লি সহযোগিতা করবে যেখানে নিজেদের স্বার্থ রয়েছে, আবার কঠোর অবস্থান নেবে যেখানে জাতীয় নিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে। ফলে বলা যায়, ভারত চীনের নেতৃত্ব নয়, বরং “সহযোগিতার কাঠামো” স্বীকার করছে। এই অবস্থান ভারতের জন্য একাধারে রাজনৈতিকভাবে নিরাপদ, কৌশলগতভাবে লাভজনক এবং ভবিষ্যতের বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থায় টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয়।
সহিদুল আলম স্বপন, সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বেসরকারি ব্যাংকিং আর্থিক অপরাধ বিশেষজ্ঞ, কলামিস্ট ও কবি

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন