শিক্ষকতার বিপন্নতা!

gbn

এই যে শিক্ষক বনাম শিক্ষার্থী, শিক্ষক বনাম অভিভাবক আর শিক্ষক বনাম রাষ্ট্র

রাজু আহমেদ,  প্রাবন্ধিক। 

শিক্ষার্থীদের হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শারীরিকভাবে নাজেহাল হওয়ার ঘটনা এখন আর বিচ্ছিন্ন নয়—দুঃখজনকভাবে তা নিত্যনৈমিত্তিক বাস্তবতা। ভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের তো বটেই, নিজ বিভাগের শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না। শিক্ষার্থীদের বচনের অশ্লীল তীরের টার্গেটে শিক্ষকগণ। সাত কলেজের স্বাতন্ত্র্যতা রক্ষার দাবিতে যখন শিক্ষকরা অবস্থান কর্মসূচি ও প্রতিবাদ মিছিল করছেন, তখন শিক্ষার্থীরা তাদের পাশে দাঁড়িয়ে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিচ্ছে—এ দৃশ্য শিক্ষা-পরিবেশের সংকটকে আরও প্রকট করে। শিক্ষকদের লক্ষ্য করে অশ্রাব্য ভাষায় অবিরাম গালাগাল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপমানজনক মন্তব্য ছড়ানো, এমনকি এআই দিয়ে শিক্ষকদের নামে বিকৃতির প্রচার—এসবই আমাদের মূল্যবোধের ভাঙনের বহিঃপ্রকাশ।

 

সরকারি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের এনক্যাডারমেন্ট ও গ্রেড উন্নয়নের আন্দোলন নিয়ে অভিভাবকদের ক্ষোভ চরমে পৌঁছেছে। প্রশাসনও বিব্রত। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের ‘তৃতীয় প্রান্তিকমূল্যায়ন’ বন্ধ রেখে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ আন্দোলন— দদএর ফলে কয়েক জায়গায় শিক্ষকদের ওপর অভিভাবক কর্তৃক শারীরিক হামলাও ঘটেছে। সারাদেশের এই শিক্ষা-সংক্রান্ত চিত্র একদিকে দুঃখজনক, অন্যদিকে আতঙ্কের। সমাজের যে স্তম্ভগুলো আমাদের ভবিষ্যৎকে টিকিয়ে রাখার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বহন করে—সেই শিক্ষকেরাই আজ বারবার অনিশ্চয়তা, অপমান ও অবিশ্বাসের মুখে দাঁড়াচ্ছেন।

 

পেশাগত নৈতিকতায় যেমন চিকিৎসকরা রোগীকে জিম্মি করে দাবি আদায় করতে পারেন না, তেমনি শিক্ষকগণও ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ রেখে দীর্ঘস্থায়ী কর্মবিরতি পালন করতে পারেন না। নৈতিক দৃষ্টিতে এটিকে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য বলা যায় না। তবে দায় একতরফা শিক্ষকদের নয়। শিক্ষকদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধে রাষ্ট্রের কোথাও কোথাও শিথিলতা, জটিলতা ও কার্পণ্য রয়েছে—এটাও বাস্তবতা। আবার শিক্ষকদের দাবিদাওয়ার ব্যানারের নিচে অনেকে অসংগতি, অযৌক্তিকতা, এমনকি রাজনৈতিক সংশ্লেষ যুক্ত করে আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্যকে বিভ্রান্ত করেছেন। ফলে একটি নৈতিক আন্দোলনও অনেক সময় জনমতের সমর্থন হারিয়ে ফেলে।

 

শিক্ষা ব্যবস্থার বড় সংকট হলো—কেউই গা-ছাড়া ভাব দূর করতে চাইছে না। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সমাধানের জায়গাগুলো এড়িয়ে যাওয়া, শিক্ষক মহলের ভেতরের অসংগতি, শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধগত অবক্ষয় এবং অভিভাবকদের আস্থাহীনতা—সব মিলিয়ে এক অচলাবস্থার জন্ম দিয়েছে। শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পারস্পরিক সমঝোতা ও আত্মসমালোচনার মানসিকতা না থাকলে টেকসই সমাধান অসম্ভব।

 

এই যে শিক্ষক বনাম শিক্ষার্থী, শিক্ষক বনাম অভিভাবক আর শিক্ষক বনাম রাষ্ট্র—এমন মুখোমুখি অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে, এর ক্ষতি সামগ্রিকভাবে আমাদেরই। শিক্ষক যদি আন্তরিকতা নিয়ে না শেখান, শিক্ষার্থী যদি সম্মান ও মনোযোগ দিয়ে না শেখে, এবং অভিভাবক যদি শিক্ষা ব্যবস্থায় আস্থা না রাখেন—তবে পরবর্তী প্রজন্ম কোথায় পৌঁছাবে? আন্দোলনরত শিক্ষকের ওপর অভিভাবকের আঘাত, শিক্ষার্থীর অশ্রাব্য গালাগাল—এগুলো নিছক ঘটনাই নয়; এগুলো সমাজে দীর্ঘমেয়াদি নৈতিক ক্ষয় ঘটায়। যারা মানুষ গড়ে তাদেরও মানুষ হতে হয়; আর যারা মানুষ হবে তাদের ভেতর মানুষ হওয়ার ইচ্ছা ও শৃঙ্খলা থাকা জরুরি।

 

কথায় বলে—বেয়াদব শিক্ষার্থীকেও মানুষ করা যায় কিন্তু বেয়াদব অভিভাবকের সন্তানকে মানুষ করা প্রায় অসম্ভব। অভিভাবকের ভুল বার্তা সন্তানের মনে যেভাবে রোপিত হয় তা পরবর্তীকালে শিক্ষা-পরিবেশের জন্য আরও বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার প্রতিবেদনে শিক্ষক আন্দোলনের কলকাঠিতে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে—যদি তা সত্য হয়, তাহলে সামনের দিনগুলোতে শিক্ষকদের অস্তিত্ব সংকট আরও প্রকট হতে পারে। নোয়াখালীর শিক্ষকদের আন্দোলনের তীব্রতা বেশি- কাজেই রিপোর্টকে উপেক্ষা করার সুযোগও কম। 

 

সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা অনেক জায়গায় প্রশ্নাতীত; তাদের বেতন, মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দাবিগুলো বাস্তবসম্মত। কিন্তু আন্দোলনে কিছু শব্দ, স্লোগান ও দাবি সংযুক্ত হয়ে আন্দোলনকে হাস্যরসে পরিণত করেছে। ‘কে বেশি মেধাবী শিক্ষক’—এমন বিতর্কে না গিয়েও শিক্ষকদের কাঠামোগত অবস্থান বোঝা উচিত ছিল। প্রধান শিক্ষক ১০ম গ্রেডে থাকলে সহকারী শিক্ষকের ১০ম গ্রেড দাবি শৃঙ্খলার সাথে যায় না। মাধ্যমিক শিক্ষকদের ৯ম গ্রেড দাবি যৌক্তিক হতে পারে কিন্তু ‘ক্যাডারে অন্তর্ভুক্তি’ দাবি কাঠামোগত বাস্তবতার সঙ্গে বেমানান। 

 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১৫ মাসে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষকগণ এত বিষয় নিয়ে আন্দোলন করেছেন যে প্রশাসন দীর্ঘদিন অচলাবস্থায় ছিল। সবচেয়ে বড় ভুল—এই আন্দোলনগুলো সমাজের দাবি হয়ে উঠতে পারেনি। জনসমর্থন ছাড়া কোনো আন্দোলনই সফল হয় না। শিক্ষকদের দাবি শিক্ষকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।

 

এই পরিস্থিতির বিপরীতে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে মাদ্রাসা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিকল্প হিসেবে আরও শক্ত অবস্থান নিবে। অভিভাবকদের আস্থা কমে গেলে সরকারি স্কুলগুলো বড় ক্ষতির মুখে পড়বে। মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ে নিয়মিত বদলি কার্যক্রম জোরদার করলে সিন্ডিকেট, স্থবিরতা, নৈরাজ্য ও ক্ষমতার অপব্যবহার কমে যেত। ভালো শিক্ষক বিপুল সংখ্যায় আছেন—কিন্তু কতিপয় শিক্ষকের দুর্নাম পুরো শিক্ষক সমাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছে।

 

শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও রাষ্ট্র—এই চার পক্ষের মধ্যে সুসম্পর্ক ছাড়া কোনো শিক্ষা ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারে না। উন্নয়নশীল দেশে আন্দোলন প্রায় অবশ্যম্ভাবী হলেও তা অবশ্যই বিধিবদ্ধ কাঠামোর মধ্যে হতে হবে। সরকারি চাকরিজীবী বিধানে আবদ্ধ—এ বাস্তবতা ভুলে গেলে চলবে না। সংখ্যার আধিক্য দিয়ে রাষ্ট্রকে জিম্মি করা যায়, কিন্তু তাতে দায়িত্বশীল নাগরিকত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় না।

 

এখন প্রয়োজন পারস্পরিক আস্থা, নৈতিক দায়িত্ববোধ ও সর্বস্তরে শৃঙ্খলার পুনঃস্থাপন। অন্যথায় শিক্ষকতার বিপন্নতা কেবল পেশার নয়—জাতির ভবিষ্যতের বিপন্নতা হয়ে দাঁড়াবে।

 

 

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন