নিজাম এম রহমান FRSA ||
মাত্র দুই সপ্তাহ আগে আমি জিবি নিউজ এ একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম — এমন একটি বিষয় নিয়ে, যা দীর্ঘদিন আমাদের দৃষ্টি থেকে আড়ালে ছিল: নীল অর্থনীতি। আমি একে বলেছিলাম “একটি সমুদ্র, যা একটি জাতিকে বদলে দিতে পারে।” আমি ভাবতেও পারিনি যে বিষয়টি এত দ্রুত মানুষের মনোযোগ কাড়বে।
সেই থেকে এই আলোচনা ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। আমার গভীর সন্তুষ্টি ও বিস্ময়ের সঙ্গে বলতে পারি, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস এই একই বিষয়ে জনসমক্ষে কথা বলেছেন — একেবারে সেই ভাষায়, যেভাবে আমি এটি দীর্ঘদিন ধরে ব্যাখ্যা করে আসছি। এটি যেন এক নিঃশব্দ চিন্তা থেকে জাতীয় পর্যায়ের আলোচনায় রূপ নিয়েছে।
⸻
মহামারির নিস্তব্ধতায় একটি উপলব্ধি
২০২০ সালে, যখন পুরো পৃথিবী থেমে গিয়েছিল, তখন আমারও সামনে ছিল সময় — কিন্তু উত্তর ছিল কম।
না ছিল ফ্লাইট, না ছিল অফিস, না ছিল ব্যস্ততা। ছিল কেবল নিস্তব্ধতা আর ইন্টারনেট।
সেই শূন্য সময়ে আমি খোঁজাখুঁজি শুরু করি — কোন সম্পদ আমাদের আছে, যা আমরা এখনো কাজে লাগাইনি? তখনই আমার যাত্রা শুরু হয় নীল অর্থনীতির জগতে। এটি কোনো ক্যারিয়ার পরিকল্পনা ছিল না, ছিল দেশের জন্য একটি উত্তর খোঁজার চেষ্টা। আর এক রাতে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা, নীতিমালা আর সমুদ্রসম্পদ নিয়ে লেখা ঘেঁটে, সমুদ্র যেন নিজেই কথা বলতে শুরু করল।
তথ্য, উপাত্ত আর সম্ভাবনার ভাষায়।
⸻
যে সমুদ্র আমাদের, কিন্তু আমরা ব্যবহার করি না
অনেকেই জানেন না — বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতভাবে ১,১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটার সামুদ্রিক এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে, যা ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সীমানা নির্ধারণের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছে।
এই সমুদ্র শুধু পানির বিস্তৃতি নয়। এটি ভরপুর মাছ, খনিজ, জীববৈচিত্র্য, বায়ু শক্তি এবং বাণিজ্য পথ দিয়ে। আন্তর্জাতিকভাবে এটি এক অপার সম্ভাবনার ভাণ্ডার। অথচ আমরা এখনো এটিকে ব্যবহার করছি না।
আমরা উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি — কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদকে অবহেলা করি।
⸻
কী সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে: নীল অর্থনীতির ৫টি স্তম্ভ
তাহলে এই সমুদ্র আমাদের কী দিতে পারে?
১. টেকসই মৎস্য ও জলজ চাষ
বর্তমানে আমাদের মৎস্য আহরণ সীমাবদ্ধ অগভীর জলে। গভীর সমুদ্রে বৈধভাবে আমাদের প্রবেশ তেমন নেই — বরং বিদেশি ট্রলাররাই সেগুলো ব্যবহার করছে। যদি আমরা আধুনিক ট্রলার, হিমাগার ও রপ্তানি অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করি, বাংলাদেশ একটি সামুদ্রিক রপ্তানি শক্তিতে পরিণত হতে পারে।
২. সামুদ্রিক জীবপ্রযুক্তি
আমাদের সাগরের জীববৈচিত্র্য এখনো গবেষণাহীন। সামুদ্রিক শৈবাল ও অণুজীব থেকে পাওয়া যায় ওষুধ, কসমেটিক্স ও স্বাস্থ্যসেবায় ব্যবহৃত উপাদান। বিশ্বের ফার্মাসিউটিক্যাল ও স্কিন কেয়ার শিল্পে এই উপাদানগুলোর ব্যাপক চাহিদা। বাংলাদেশ এখানে প্রবেশ করতে পারে গবেষণা কেন্দ্র ও বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে।
৩. অফশোর বায়ু ও জোয়ার শক্তি
কক্সবাজার ও কুয়াকাটা অঞ্চলে বাতাস ও জোয়ারের যে প্রবাহ রয়েছে, তা পরিবেশবান্ধব শক্তি উৎপাদনের আদর্শ উৎস। বাহির থেকে জ্বালানি আমদানি না করে, আমরা সমুদ্র থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি।
৪. বন্দর উন্নয়ন ও ট্রান্সশিপমেন্ট
পায়রা, মোংলা ও মাতারবাড়ি বন্দর পরিকল্পিত বিনিয়োগের মাধ্যমে আঞ্চলিক বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে। নেপাল, ভুটান, ভারত এমনকি চীনের পণ্য এই পথে যাতায়াত করতে পারে।
৫. ইকো-ট্যুরিজম ও উপকূলীয় উন্নয়ন
সুন্দরবন, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত ও বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলো একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। সঠিক পরিকল্পনা ও পরিবেশবান্ধব নীতির মাধ্যমে আমরা বিশ্বমানের ইকো-ট্যুরিজম গড়ে তুলতে পারি।
⸻
কেন এখন? কারণ আর দেরি করা যাবে না
বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রধানত পোশাকশিল্প ও প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরশীল — যা বিশ্ব বাজারের ওঠানামার সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও স্পষ্ট। তরুণ প্রজন্ম কর্মহীন। উপকূলীয় অঞ্চলে এখনো উন্নয়নের ছোঁয়া পৌঁছায়নি।
নীল অর্থনীতি বিলাসিতা নয় — এটি জরুরি বাস্তবতা। • বিলিয়ন ডলারের জিডিপি সম্ভাবনা • কোটি মানুষের কর্মসংস্থান • রপ্তানির নতুন দিগন্ত • জ্বালানি নিরাপত্তা • প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার
⸻
তাহলে এখনও পিছিয়ে কেন?
আমরা দেরিতে শুরু করেছি, কিন্তু এখনো সুযোগ শেষ হয়নি।
আমাদের দরকার নীতি নির্ধারকদের সাহসী পদক্ষেপ, অবকাঠামোগত বিনিয়োগ, এবং একটি সুস্পষ্ট জাতীয় পরিকল্পনা। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যেন তারা শুধু জমিতে নয়, সমুদ্রেও ভবিষ্যৎ গড়তে জানে।
প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, এবং সময়সীমা নির্ধারিত কর্মপরিকল্পনা।
⸻
একটি আশার ঢেউ
আমি যখন প্রথম মহামারির সময় এই বিষয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করি, তখন এটি নিছক আমার একান্ত আগ্রহ ছিল। আজ এটি একটি জাতীয় আলোচনার বিষয়।
আর যখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস নিজে এই বিষয়ে কথা বলেন, তখন বুঝতে কষ্ট হয় না — এটি আর কোনো ভবিষ্যৎ ভাবনা নয়, এটি বর্তমান বাস্তবতা।
আমি এই লেখাগুলো লিখছি একজন রাজনীতিক হিসেবে নয়, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে — যিনি বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশ কেবল টিকে থাকার জন্য নয়, নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। আর সেই নেতৃত্বের পথ দেখাবে নীল অর্থনীতি।
আমরা ইতিমধ্যেই সমুদ্রের মালিক। এখন সময় এসেছে, সেই সমুদ্রের সঙ্গে আমরা উঠে দাঁড়াই।
 
                            
                             
                                                                                                
 
                                                                                                     
                                                                                                     
                                                                                                     
                                                                                                     
                                                                                                     
                                                                                                     
                                                                                                    
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন