একজনের অনৈতিক ও অবিবেচনাপ্রসূত সঞ্চয়ের নেশা বহুজনকে অধিকারহারা করে---
রাজু আহমেদ, কলাম লেখক।
ধরুন, আজ পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেল। আপনার ফ্রিজে যে মাছ-মাংস এবং তরকারি সঞ্চিত ছিল তাতে পরিবারের আরও পনেরো দিন চলত! কাল্পনিক দুনিয়া ছেড়ে এবার বাস্তবতায় আসুন। বাজারে মাছ-মাংসের যে সংকট সেসবের সিংহভাগ কমে যাবে যদি ফ্রিজিং করা বন্ধ হয়। বন্ধ মানে কিন্তু একেবারেই বন্ধ না। শুধু প্রয়োজনের অতিরিক্ত অংশ মজুদ করা বন্ধ করলেই হবে। নিত্য ব্যবহার্যের সুষম বণ্টনের পরে উদ্বৃত্ত থাকলে তবেই সঞ্চয় করা যাবে- এই নীতিবোধ মানুষ মেনে নিলে তবে দেশে বৈষম্য কমবে। প্রয়োজনের সীমা? একটু বাদেই বলছি।
অভিজ্ঞতা শুনুন, গত রেমালে আমাদের অঞ্চলে কয়েকদিন বিদ্যুত ছিল না। বিদ্যুৎ আসবে আসবে এই আশায় অনেকেই ফ্রিজ খোলেনি। তিনদিনেও যখন বিদ্যুতের সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি তখন আর ফ্রিজের কিছুই ব্যবহারের মতো অবস্থাতে ছিল না। ওদিকে বাজারে মাছ কেনারও লোক ছিল না- যোগান এতো বেশি ছিল। এক লাফে মাছ-মাংস, সবজি-ফলের দাম প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছিল। ক্রয়ক্ষমতা সকলের সামর্থ্যে এসেছিল। এতে উৎপাদকরা সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হলেও যারা এক টাকা বিনিয়োগে তিন কিংবা তেরো টাকা মুনাফা করে তারা মোটামুটি বিপর্যস্ত হয়েছিল, মানসিকভাবে!
মজুদ বা সঞ্চয় করার প্রবণতা কমে গেলে অভাব কমে যাবে। মানুষের ভোগান্তির লাঘব হবে। মাত্রাতিরিক্ত মজুদে দু'টো বড় ক্ষতি হয়। প্রথমত: বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়। যে কারনে পণ্যের দাম আকাশ ছোঁয়। দ্বিতীয় : খাদ্যদ্রব্যের প্রকৃত স্বাদ হারায়। ফলাফলে, ত্রিশ বছর আগে যেসব রোগের কথা দুনিয়াবাসী জানতো না সেসব মরণঘাতী রোগে আমরা প্রায় সবাই আক্রান্ত। পৃথিবীতে যখন মজুদ সিস্টেম চালু হয়নি, সভ্যতার ইতিহাস বলছে, তখনও কেউ খাদ্যের অভাবে মারা যায়নি। আর এখন মজুদের মহাকাল চলছে। অথচ ক্ষুধায় অগণিত মানুষ মারা যাচ্ছে। অপুষ্টিতে ভুগছে কোটি কোটি আদম-হাওয়ার সন্তান। এখানে এবং আফ্রিকায়। সামর্থ্যবানদে ফ্রিজগুলোর পেট কানায় কানায় মাছ-মাংসে ঠাসা থাকায় দেশের উল্লেখযোগ্য অংশের শিশুরা আমিষবিহীন আধপেটা খাবারে বাড়ছে। এর খেসারত অচিরেই দিতে হবে।
বাসায় পেটমোটা ফ্রিজে ভরে রাখবেন বলে বাজারের সব তুলে নিয়ে যাওয়ায় দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সারির ক্রেতাদের ক্রয় সক্ষমতার ঘাটতিতে তাদের কাছে কাছে নিত্য আহার্য পণ্যের সংকট বাড়ছে। প্রশ্ন আসতে পারে, যারা মজুদের জন্য কেনাকাটা তারা তো দিন দিন বাজারে আসে না। কথা সত্য। তবে সঞ্চয়ের জন্য যখন যা যা কেনা হয় তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত। প্রতিদিনের বাজার প্রতিদিন করলে তা দিয়ে পেটের ক্ষুধা মেটে কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য জমা করলে চোখের ক্ষুধাও বেড়ে যায়। আগামীকাল লাগবে- এ চিন্তায় মানুষের বাস্তবতার বোধ লোপ পায়। তখন সে উম্মাদের মত ক্রয় করে।
এই তত্ত্ব ও তথ্য শুনে ফ্রিজ বিক্রি করা ব্যসায়ীরা আমার দিকে তেড়ে আসবেন! এই ব্যাটা বলে কি! সে আসুক। কিন্তু বিজ্ঞানের এই আবিস্কার বহুক্ষেত্রে প্রভূত সহায়তা করলেও অবৈধ ব্যবসায়ীরা মজুদের সাম্রাজ্য কায়েম করেছে এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন লোভের ক্ষুধা মানবসভ্যতার জন্য বহুবিধ ক্ষতি করছে। আজ থেকে তিনদিন বিদ্যুতের অনুপস্থিতি ঘটলে কত হাজার কোটি টাকার খাবার নষ্ট হবে- ভাবতে পারছেন? আমরা ভবিষ্যতের জন্য এতো বেশি জমিয়ে রাখছেন যাতে লাখ লাখ লোক প্রতি রাতে তাদের প্রয়োজনীয় আহারের উৎস সংস্থানে সক্ষম না হয়ে ক্ষুধা পেটে ঘুমাতে যায়। একজনের অনৈতিক ও অবিবেচনাপ্রসূত সঞ্চয়ের নেশা বহুজনকে অধিকারহারা করে।
বাজার করার মানুষ নাই- এমন হলে দু'বেলার খাবার জমা করুন। কিন্তু সস্তায় পেয়েছেন বলে অনেককিছু ফ্রিজিং করবেন না। এতে অন্যের হক নষ্ট হয়। মানুষের চেয়ে সম্পদ সবসময় সীমিত। কাজেই কেউ যদি অতিরিক্ত জমায় তবে সে কারো না কারো ক্ষুধার্ত থাকার পরোক্ষ কারণ। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সঞ্চয়কারী এবং তা বারবার গণনাকারীর নামে প্রভুর অভিসম্পাত। আপনি অনেক জমিয়েছেন, নিশ্চিত নন এসব ভোগ করতে পারবেন কি-না, অথচ কোন এক অসহায় বাবা পরিবারের জন্য চাল এবং প্রয়োজনীয় বাজার সদাই কিনতে পারেনি- এ পাপ আপনাকে ছাড়বে? প্রশ্ন, সে পারেনি বলে সে পাপে কেন আমাকে ধরবে?
আপনি যখন আপনার প্রয়োজনের অতিরিক্ত ক্রয় করেন তখন বাজারে মালামালের সংকট তৈরি হয়। কেননা যোগান সীমিত। মালামালের চাহিদা যখন বেড়ে যায় তখন উৎপাদক কিংবা ব্যবসায়ী দাম বাড়ায় কিংবা বাড়াতে বাধ্য হয়। এই যে দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতির চেইন বা চক্র তাতে মজুদের প্রবণতা সরাসরি প্রভাব ফেলে। ক্রেতার চাহিদা যখন প্রয়োজনের বেশি হয় তখন ব্যবসায়ীরা সেটা বুঝতে পারে এবং কৃত্রিম সংকট করে দাম বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া বাজারে সিন্ডিকেট সমস্যা তো বাংলাদেশের আজন্মের সমস্যা। মানুষকে স্বস্তি দিতে, জীবনযাত্রা সহজ করতে প্রয়োজনীয় অংশটুকু কিনুন। ফ্রিজিং কিংবা মজুদের রোগ আমাদের ভোগবাদী সমাজের দিকে ডাকছে। যা আদৌ মানবসভ্যতার জন্য উপকারী নয় বরং ধ্বংসাত্মক। লোভ কিংবা মোহে নয়, মানবতায় জীবন সম্মৃদ্ধ হোক।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন