সীমান্ত হত্যা বন্ধের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে পারি কিন্তু যে ভারতের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সময় কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।|
ইন্ডিযাতে ইলিশ পাঠানো উচিত। আসন্ন পূজোয় বাংলাদেশ থেকে সাধ্যমত ইলিশের চালান উপহার হিসেবে দেওয়া দরকার। সেটা ভারতের চাহিদা মত না হলেও আমাদের সামর্থ্য মত হতে পারে। তাদের সাম্প্রতিক কার্যকলাপে হাজার কারন দেখিয়ে ভারতে ইলিশ না পাঠানোর যুক্তি খাড়া করা যায়। তবে বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশি ভারতে পূজোয় ইলিশ পাঠালে সেটা তাদের ভুলের মোক্ষম জবাব হবে। যেহেতু উপলক্ষ্য পূজো এবং ইলিশের সাথে ধর্মীয় উৎসব রঙিন করতে চায়, কাজেই তাদের প্রার্থণার আলোকে ইলিশের বরতন নিয়ে এগিয়ে যাওয়া আবশ্যক মনে করি। ইলিশ না চেয়ে যদি তারা আমাদের বন্দর ব্যবহার করতে চাইতো, আকাশ সীমায় নতুন করে অধিকার চাইতো কিংবা করিডোর সুবিধা আদায় করতে চাইতো তবে সেসবের সাথে ভিন্নমত পোষণ করতাম। প্রতিবাদ-প্রতিরোধে রাস্তায় নামতাম, কাগজে লিখতাম কিংবা কথা বলতাম। শত কারনে আমি ভারতের শাসক দলের নীতির বিরোধিতা করি। তবে যে ভারতবাসী বাংলাদেশের গণমানুষের পক্ষে কথা বলে, আমি সেই ভারতবাসী বিরোধিতা কখনোই করি না। সীমান্ত হত্যা বন্ধের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে পারি কিন্তু যে ভারতের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সময় কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছে- আমি সেই কৃতজ্ঞতার ঋণ অস্বীকার করতে পারি না।
আমাদের ইলিশ আছে। জেলেদের জালে এ বছর প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। বাজারগুলোতে সকল প্রকারের মাছের সম্মিলিত অংশের সাথে ইলিশ একাই সমানে লড়ে যাচ্ছে। অতীতের তুলনায় যোগান অনেকই বেশি হলেও দামও বেশ চড়াই মনে হচ্ছে। যেহেতু ইলিশ খাদ্য দ্রব্য এবং কেউ কোন খাদ্য চাইলে তাকে সেটা না খেতে দেয়াও ভদ্রতা নয়। খাদ্য ভাগাভাগি করে খাওয়ার মধ্যেই কল্যাণ; শত্রু হলেও তার সাথেও এ নীতির পরিপন্থি পথে হাঁটা ঠিক নয়। এমন নয় যে, বাজারে ইলিশের সংকট চলছে এবং আমাদের লোকেরা খেতে পাচ্ছে না। দাম চড়া হলেও দেশের মানুষ ইলিশ খাচ্ছে, আরাম পাচ্ছে। আসন্ন পূজোয় ভারতাবাসী যদি সামান্য হলেও পদ্মার ইলিশ খেয়ে তাদের উৎসবকে রঙিন করতে পারে তবে তাদের দেশে ইলিশ যাক। জেলেরা আরও লাভবান হোক, ব্যবসায়ীরাও মুনাফা করুক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী, পশ্চিম বঙ্গের মূখ্যমন্ত্রীসহ আরও কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে বাংলাদেশ থেকে ইলিশ উপহার পাঠালে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও উন্নত হবে। শাসকদলের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশ বিরোধিতা করে বক্তব্য-বিবৃতি দেয় তাদেরকে ইলিশ পাঠাতে যাতে ভুল না হয়। আমাদের দেশের যে সকল ব্যক্তিবর্গ ভারতের মেহমান হয়ে আছে তাদেরকেও ইলিশের ভাগ পাঠানো হোক! বাংলাদেশের জনগণের প্রতি ভারতের নির্মমতা আমাদেরকে ব্যথিত করে। প্রতিশোধের ইচ্ছাও হয়তো জাগ্রত করে কিন্তু সেটা ইলিশ না দিয়ে শোধ তোলা উচিত হবে না। খাদ্যদ্রব্য আটকিয়ে মানুষের সাথে মানুষের যুদ্ধ করা উচিত নয়। তারা পানি দিযে আমাদের ডোবাতে পারে কিন্তু আমরা সেই পানিতে থাকা ইলিশ পাঠিয়ে তাদেরকে ভালোবাসা জানাতে পারি। সুস্বাদু খাবারের স্বাদ পৃথিবীর সকল মানুষের নাগালে থাক।
আশা করছি. ভারতের সাথে যে অম্লতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তা স্থায়ী হবে না। বাংলাদেশ এবং ভারত- উভয় দেশের স্বার্থে দু’দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারবে। যে নিকট প্রতিবেশি সে ধণী হোক কিংবা নির্ধণ- সদ্ভাব বজায় রেখেই চলতে হয়। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক সূত্রে গাঁথা এবং ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থেই বাংলাদেশকে গুণতে হবে- কাজেই বৈরিতার সম্পর্ক ধরে রাখলে দু’পক্ষেরই ক্ষতি হবে। এতোদিন বাংলাদেশ থেকে প্রতিরোধ পায়নি বলে ভারত বিবেকহীন প্রতিবেশিসূলভ আচরণের সুযোগ পেয়েছে এবং বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠীর সুবিধার জন্য নতজানু কূটনৈতিক আচরণ বজায় রেখেছে। সেজন্য বাংলাদেশ ন্যায্য পানি পায়নি, সীমান্ত হত্যা বজায় থেকেছে এবং কোন আগাম সতর্কতা ছাড়াই বারবার ব্যবসায়িক চুক্তি অমান্য করে পণ্য রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। বাংলাদেশের আকাশসীমা ব্যবহার করে, করিডোর-ট্রানজিট সুবিধা আদায় করে ভারত তার স্বার্থে সময় ও অর্থ সাশ্রয় করেছে। ভারত বাংলাদেশের সথে সাথে সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে কখনো কখনো বন্ধুত্ব ভাবাপন্ন থেকেছে আবার কখনো কখনো মোড়লগিরি করেছে। তবে সময় এসেছে, ন্যায্যতার ভিত্তিতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের। যেখানে বুক দেখানো প্রয়োজন সেখানো বুক দেখানোর এবং পিঠ দেখানোর প্রয়োজনেও পিছপা না হওয়া!
ভারতের সাথে বাংলাদেশের নতুন শুরুটা ইলিশ কূটনীতির মাধ্যমে আরম্ভ হতে পারে। তারপরেও যদি আশঙ্কা থাকে যে, ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও বেজায় অবনতির দিকে যাবে তবুও আসন্ন পূজোয় ভারতকে ইলিশ দেওয়ার পক্ষে অবস্থান করবো, দাবি জানাবো। ভারতের সাধারণ মানুষ যাতে খাবার নিয়ে বসে প্লেটে বাংলাদেশের ইলিশ না পাওয়া নিয়ে আফসোস না করে। রবের অসীম রহমতে বিশ্বের ইলিশের মোট উৎপাদনের ৮২ শতাংশ বাংলাদেশের মানুষের হাতে আসে। কাজেই এই নিয়ামতকে বিস্তৃত করতে হবে। আমাদের দেশের যা নাই, যা হয় না তাও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের দেশে আসে। আমাদের কাছে থাকা হাজার হাজার টন রুপোলি ইলিশের অসামান্য স্বাদ প্রতিবেশিসহ বিশ্ববাসী উপভোগের সুযোগ যাতে পায়- সেই ব্যবস্থা হোক। কড়কড়ে ইলিশ ভাজা খেতে খেতে যাতে মানুষ বলতে পারে- এই মজাদার মাছ বাংলাদেশের ন্যাশনাল ফিশ! যে পরিমান ইলিশ জেলেদের জালে ধরা পড়ছে তার সিকি অংশও বাজারে আসছে না। আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা ক্লোল্ড স্টরেজে মজুদ করছে। অতিরিক্ত সামর্থ্যবানরা অপ্রয়োজনীয় অংশ ফ্রিজে সামলাচ্ছে! সেজন্যই লোকাল বাজারগুলোতে ইলিশের দাম কমেনি। ইলিশ মৎস খাদ্য খায় না, হ্যাচারিতে লালন করতে হয় না কিংবা রোগ-বালাইতেও তেমন মরে না। তবুও ইলিশের আকাশ ছোঁয়া দাম রহস্যজনক। সিন্ডিকেট এখনো ভাঙেনি। জেলে লাভবান হলেও তাও কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্য বদল হচ্ছে ফড়িয়াদের। ভারতে ইলিশ পাঠিয়ে দেশের মানুষের সাথে ভারতের সাধারণ জনসাধরণের মেলবন্ধন ঘটানো উচিত।
ভারত যে বছর কোরবানির ঈদের কয়েকদিন পূর্বে বাংলাদেশকে গরু দিবে না বলে ঘোষণা দিয়েছিল- সে বছরের স্মৃতি এখনো বিস্মরণ হয়নি। তবে প্রতিশোধ যদি ইলিশ দিয়েই নেওয়া হয় তবে, 'তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন’- এই সত্যের মুখোমুখি আর কোনদিনই হওয়া হবে না। শেখ সাদীর উত্তম ও অধম কবিতার মানুষ ও অমানুষের মধ্যকার আচরণের বিস্তর ফারাক তিনি দেখিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত বহুবার অহংকার দেখিয়েছে। আমাদের পেষণ-শোষণ করার চেষ্টা করেছে। পিঁয়াজের রপ্তানি বন্ধ করে দিয়ে দাম চড়া করেছে। চাল রফতানি বন্ধ করেছে। ন্যায্যতার ভিত্তিতে পানি বন্টন চুক্তি করেনি কিংবা যে সকল চুক্তি সই করেছিল সেগুলোও ন্যায়-নীতির সাথে বাস্তবায়ন করেনি। ’৭১ পরবর্তী বাংলাদেশের সাথে ভারত কখনোই সখ্যতা করতে চায়নি বরং নির্দিষ্ট কোন দলের সমর্থন করে তাদের স্বার্থ হাসিল করেছে। এদেশের সাধারণ মানুষের ইচ্ছাকে বারবার বলি দিয়েছে। ভারতকৃত সব ভুলের শাস্তি হিসেবেও ইলিশ প্রদান থেকে বিরত থাকা উচিত হবে না। যদি সক্ষমতা থাকে, এমনকি যদি ভোগ হৃাস করে হয় তবুও ভারতে কয়েক টন ইলিশ পাঠানো উচিত। মোদি সরকারের চরিত্র আর ভারতবাসী চরিত্র সমান নয়। পারস্পারিক ভালোবাসার ক্ষেত্রে দু’দেশের সাধারণ মানুষ চিরকাল উদারতা দেখিয়েছে। দুই দেশের মানুষকে রাষ্ট্রীয় সীমানার কাঁটাতার আলাদা করেছে বটে কিন্তু তাদের মধ্যকার ভালোবাসা কোনদিন ভাগ হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ও বাঙালিকে চির আপনার মানুষ বলেই মনে হয়। ওখানেও আমার ভাইদের প্রতিচ্ছবি দেখি।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন