মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে ৪ অস্থিরতায় নাকাল দেশবাসী

gbn

বিশেষ প্রতিনিধিঃদেশের কোথাও স্বস্তি নেই মানুষের। একের পর এক ঘটনা-দুর্ঘটনায় মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। একদিকে করোনার ভয়াল থাবায় বিপর্যস্ত জনজীবন, তার ওপর দেশব্যাপী চলমান-ঘটমান নানা অস্থিরতায় নাকাল হয়ে পড়ছে মানুষ। মহামারি করোনার কারণে জীবন নিয়ে উদ্বেগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরিবাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তা, সন্তানদের লেখাপড়া নিয়ে অনিশ্চয়তা, সমাজের ঘৃণ্য কিছু লোকের কবলে পড়ে মান-সম্মান ও ইজ্জত-আব্রু হারানোর শঙ্কা, চোর-ডাকাত আর প্রতারক-বাটপারদের খপ্পরে পড়ে সহায়-সম্পদ হারানোর আতঙ্ক, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা, মানব পাচারকারীদের ফাঁদে পড়ে জানমাল খুইয়ে পথে বসার মতো নানা অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির শিকার হওয়ার ভয়ে দেশের মানুষের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। এসব অস্থিরতা মানুষকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে, যেন এর থেকে পরিত্রাণের কোনো পথ নেই। বর্তমানে দেশের মানুষকে যে ৪টি অস্থিরতা একেবারে নাকাল করে ফেলছে, সেগুলো হলো করোনাভাইরাস, ধর্ষণ, প্রতারণা ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি।  করোনাভাইরাস : ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান প্রদেশ থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস ইতিমধ্যে সারা বিশ্বের ২২০টি দেশ ও অঞ্চলে আঘাত হেনেছে। চলতি বছরের মার্চের শুরুতে করোনার ভয়াল থাবা বাংলাদেশেও বিস্তার লাভ করে। ৭ মাস ধরে চলা করোনার তাণ্ডবনৃত্যে জনজীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্দশা। এর প্রভাবে অনেকে হারিয়েছেন চাকরি, অনেকের কমে গেছে বেতন-ভাতা, উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে বেকারত্ব, অধিকাংশ মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্যে নেমেছে ধস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাণচঞ্চল শিক্ষার্থীরা ঘরে বন্দি হয়ে আছে, বেড়েছে পারিবারিক ও সামাজিক জটিলতাÑএককথায় মানুষের জীবনের গতিধারা পুরো উলটপালট করে দিয়েছে এই মহামারি। করোনা কেড়ে নিয়েছে অনেক মানুষের মহামূল্যবান জীবন। আবার অনেকে আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হলেও শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছেন। অধিকাংশ মানুষের আয় কমে যাওয়ায় অর্থসংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। অনেক পরিবার আবার স্বজন ও অর্থ দুটিই হারিয়ে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে। বলা যায়, মানুষ এক দুর্বিষহ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে একপ্রকার বাধ্যই হচ্ছে। করোনার সর্বগ্রাসী আগ্রাসনে বিশ্বসহ সারা দেশে যে অবর্ণনীয় বিপন্নতা, তাকে সামলাতে আরও কত সময় ব্যয় করতে হবে তা ধারণা করাও মুশকিল।  এদিকে প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ৬ অক্টোবর মঙ্গলবার পর্যন্ত সারা দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩ লাখ ৭১ হাজার ৬৩১ জন আর মৃত্যুবরণ করেছেন ৫ হাজার ৪০৫ জন। আক্রান্তদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২ লাখ ৮৪ হাজার ৮৩৩ জন। যদিও আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা সরকারি হিসাবের অনেক বেশি বলে দেশবাসীর ধারণা।  ধর্ষণ : দেশের আমজনতার মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টির অন্যতম কারণ ধর্ষণ। দেশে অতীত ও বর্তমানের চিত্র তুলনা করে দেখা যাচ্ছে, একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটার পর তারই পুনরাবৃত্তি ঘটছে ধারাবাহিকভাবে। বর্তমান সময়েও ধর্ষণ সমসাময়িক এক অস্থিরতার নাম। দেশের যত্রতত্র যার-তার দ্বারা আজ সংঘটিত হচ্ছে ধর্ষণের ঘটনা। ছাত্রলীগের মতো প্রাচীন সংগঠনের নেতাকর্মীরাও মেতে উঠেছে ধর্ষণ-গণধর্ষণকাণ্ডে।  সিলেটের এমসি কলেজে গৃহবধূকে গণধর্ষণ, নোয়াখালীতে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনার রেশ না কাটতেই আরো কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনায় জনমনে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। ১ অক্টোবর সাভারের আশুলিয়ায় ১০ বছরের শিশুকে ধর্ষণ, কক্সবাজারের টেকনাফে মাদ্রাসাশিক্ষক কর্তৃক শিশুছাত্রী ধর্ষণ এবং কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক প্রেমিকা। ২ অক্টোবর হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে রাতভর মা ও মেয়েকে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ৩ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জে নানার বাড়িতে বেড়াতে আসা ফুপাতো বোনকে মামাতো ভাইয়ের ধর্ষণ, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় নবম শ্রেণির এক স্কুলছাত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া এক ছাত্রের ধর্ষণ, সিরাজগঞ্জে টেক্সটাইল মিলে ম্যানেজার কর্তৃক নারী শ্রমিককে ধর্ষণ, বাগেরহাটের মোংলায় ৭ বছরের শিশুকে ধর্ষণ এবং সিলেটে শ্রমিক লীগ নেতা কর্তৃক পাঁচ সন্তানের জননীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ৪ অক্টোবর লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে ঘরে ঢুকে হাত-পা ও মুখ বেঁধে বিধবা নারীকে দল বেঁধে ধর্ষণ, কুষ্টিয়ার মিরপুরে মাদ্রাসার সুপার কর্তৃক ছাত্রীকে ধর্ষণ, জয়পুরহাট পৌর শহরে ১২ বছরের শিশুকন্যাকে ধর্ষণ এবং রাঙামাটির নানিয়ারচরে ৮৫ বছরের বৃদ্ধ কর্তৃক প্রতিবন্ধী শিশুকে ধর্ষণের খবর পাওয়া গেছে। ৫ অক্টোবর সাভারে চাকরি দেওয়ার নাম করে ইতালি-ফেরত প্রবাসী কর্তৃক এক গৃহবধূকে ধর্ষণ ও ভোলার চরফ্যাশনে আবাসিক হোটেলে আটকে গৃহবধূকে ধর্ষণ করা হয়েছে।  ধর্ষণ নিয়ে সারা দেশে ব্যাপক ক্ষোভ ও প্রতিবাদের মধ্যেই চলতি অক্টোবর মাসের প্রথম ৫ দিনে ১৫টি ধর্ষণের ঘটনা দেশবাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। নারীরা রীতিমতো আতঙ্কিত ও অস্থিরতায় ভুগছেন। তাই করোনার ভয়কে উপেক্ষা করে এই মহামারি ধর্ষণকে রুখতে ঢাকাসহ সারা দেশে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করছেন। ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলার অবনতিসহ সামাজিক অবক্ষয়কে দায়ী করছেন সচেতন মহল।  প্রতারণা : সাধারণ মানুষের অস্থিরতার আরেক কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতারণা। প্রতারণার আইডল রিজেন্ট সাহেদের প্রতারণাকাণ্ডের পর থেকেই শুরু হওয়া প্রতারণা কিংবা প্রতারক ও তাদের সংঘবদ্ধ চক্রের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না প্রশাসন। বরং বেড়েই চলেছে। অভিনব প্রতারণার দায়ে সম্প্রতি সাহেদ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেও সক্রিয় রয়ে গেছে আরও অসংখ্য প্রতারক। সেসব প্রতারকের রয়েছে আবার সক্রিয় চক্রও। সাহেদের পরপরই একে একে বেশ কটি প্রতারক চক্রকে অভিযোগের ভিত্তিতে আটকও করেছে প্রশাসন। তার মধ্যে কুমিল্লার মেয়ে সাদিয়া জান্নাতের পাত্রী চাই প্রতারণা, রিয়েল এস্টেট প্রতারক ইমাম হোসেন নাসিমের প্রতারণাসহ সব কটি চক্রের সক্রিয়তায় দেশের মানুষের মধ্যে অস্থিরতা বেড়েই চলেছে।  এদের বাইরেও রয়েছে মানব পাচারকারী প্রতারক চক্র। সক্রিয় রয়েছে ভারতে নারী পাচার চক্রও। প্রশাসনের নজর এড়িয়েই নির্বিঘ্নে মানব পাচার করে যাচ্ছে সেসব চক্র। ইতিমধ্যে প্রশাসনের তৎপরতায় বেশ কিছু প্রতারককে চিহ্নিত এবং আটক করা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে অসংখ্য চক্র। সম্প্রতি জান্নাতুল জেরিন ও মহসিনুজ্জামান প্রতীক নামের এক দম্পতিকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। তারা স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে রাজধানীর সবুজবাগে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ভারতে নারী পাচার করত। তরুণীদের মালয়েশিয়ায় চাকরি ও আয়েশী জীবনের কথা বলে পাঠাত ভারতে, পরে বিক্রি করে দিত মুম্বাইয়ের পতিতালয়ে। এভাবে গত পাঁচ বছরে অর্ধশতাধিক তরুণীকে পাচার করে চক্রটি।  অন্যদিকে ব্রুনাইয়ে শ্রমিক হিসেবে যাওয়ার পর এক নারীর সঙ্গে যৌথভাবে, কখনো এককভাবে ওয়ার্ক পারমিটে, কখনো ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক পাঠানো শুরু করে মানব পাচার চক্রের মূল হোতা মেহেদী হাসান বিজন। নিজের বৈধ রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি না থাকলেও ব্রুনাইয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘নামসর্বস্ব’ ১৫টি কোম্পানির চাহিদায় বৈধ রিক্রুটমেন্ট এজেন্সির মাধ্যমে লোক পাঠাত সে। সর্বশেষ দেশের চার শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে তিন কোটি টাকা নিয়ে মাত্র ৬০ জনকে ব্রুনাইয়ে নিয়ে যায় বিজন চক্র। কাজ না পেয়ে দেশটির রাস্তায় রাস্তায় কাটে তাদের দিন। পরে পরিবারের আর্থিক সহযোগিতায় গত জানুয়ারিতে দেশে ফিরে আসেন তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০ হাজার লোককে পাচার করা হয়েছে। হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকা। এ রকম আরও অসংখ্য মানব পাচার চক্র সক্রিয় দেশে, যাদের দৌরাত্ম্য বন্ধ না হওয়ায় আমজনতার মধ্যে বিরাজ করছে অস্থিরতা।  দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি : দ্রব্যমূল্যের বাজারে হঠাৎ শুরু হয়েছে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে বিভিন্ন রকমের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। আর নিত্যপণ্যের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের সাথে অস্থিরতারও কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এতে জনজীবনেও দেখা দিয়েছে নতুন আতঙ্ক। সাধারণ মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় হিমশিম খাচ্ছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। একশ্রেণির মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেটের কারণে বাজারে সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, চিনি, সবজিসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের মূল্য আকাশচুম্বী হওয়ায় সাধারণ শ্রমজীবীরা পরিবার-পরিজন নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। ফলে জনমনে বিরাজ করছে অস্থিরতা।  দেশের সুশীল নাগরিকরা মনে করছেন, সর্বত্রই আজ শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো যদি কাজ না করে, তাহলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। বর্তমানে দেশের প্রতিটি সেক্টরেই ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, নিয়মনীতির বালাই নেই। বর্তমান অস্থিরতা তারই প্রতিফলন। তাদের মতে, সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে বাড়াতে হবে নজরদারি, নিশ্চিত করতে হবে জবাবদিহি। আইনের যথার্থ প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই। তাতে অস্থিরতা কিছুটা হলেও নিরসন করা যেতে পারে।

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন