থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে যখনই অচলাবস্থা দেখা দেয়, ইতিহাস বলে—শেষমেশ সেনাবাহিনীই ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নেয়। ১৯৩২ সালে নির্বিচার রাজতন্ত্রের অবসান হওয়ার পর দেশটিতে অন্তত ১২ বার সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে, যার মধ্যে দুটি হয়েছে গত দুই দশকে।
এখন আবারও প্রশ্ন উঠছে—থাইল্যান্ড কি নতুন করে আরেকটি সেনা অভ্যুত্থানের দিকে এগোচ্ছে?
পায়েতংতার্নের প্রধানমন্ত্রিত্ব স্থগিত, সরকার টালমাটাল
গত ১ জুলাই থাইল্যান্ডের সাংবিধানিক আদালত প্রধানমন্ত্রী পায়েতংতার্ন শিনাওয়াত্রাকে সাময়িকভাবে দায়িত্ব পালন থেকে অব্যাহতি দেন। আদালত তার বিরুদ্ধে দায়ের করা একটি পিটিশনের চূড়ান্ত রায় না দেওয়া পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।
এর আগে, গত ১৮ জুন ক্ষমতাসীন জোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল সরকার ছেড়ে বিরোধী দলে যোগ দেয়। ফলে সংসদের নিম্নকক্ষে মাত্র ছয় আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টিকে আছে জোট। ২৮ জুন হাজারও বিক্ষোভকারী ব্যাংককে প্রধানমন্ত্রী বরখাস্তের দাবিতে রাজপথে নামে।
এ ঘটনাগুলো অনেক থাই নাগরিককে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে অতীতের দুই অভ্যুত্থান—২০০৬ সালে পায়েতংতার্নের বাবা থাকসিন সিনাওয়াত্রা এবং ২০১৪ সালে তার ফুপি ইংলাক সিনাওয়াত্রার সময়কার কথা। উভয়ের ক্ষেত্রেই আদালতের রায়, রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও সড়ক বিক্ষোভের মধ্যে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে।
শুধু সীমান্ত বিবাদ নয়, কেন্দ্রে সিনাওয়াত্রা পরিবারও
পায়েতংতার্নকে সাময়িক বরখাস্তের সরাসরি কারণ ছিল একটি সীমান্ত ইস্যু। কোরাত সীমান্তে কম্বোডিয়ান এক সেনাকে হত্যা করেন এক থাই সৈনিক, যা দুই দেশের মধ্যে পুরোনো বিবাদকে আবার উসকে দেয়। এই ইস্যুতে কম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হুন সেনকে ফোন করে আলোচনা করতে গিয়ে পায়েতংতার্ন থাইল্যান্ডের একজন জেনারেলকে কটাক্ষ করেন এবং হুন সেনকে ‘আঙ্কেল’ বলে সম্বোধন করেন। ফাঁস হওয়া সেই রেকর্ডকে কেন্দ্র করে তাকে ‘নৈতিকতা লঙ্ঘন’-এর অভিযোগে আদালতে তোলা হয়।
কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি মূলত একটি অজুহাত। সিনাওয়াত্রা পরিবারকে রাজনীতি থেকে সরাতে থাই রাজতন্ত্রপন্থি এলিটদের দীর্ঘদিনের চেষ্টা রয়েছে।
রাজনীতিতে থাকসিনের ছায়া
২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়া থাকসিন সিনাওয়াত্রা জনপ্রিয় পপুলিস্ট কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের দরিদ্র জনগণের আস্থা অর্জন করেন। কিন্তু সেনাবাহিনী, রাজতন্ত্র ও ব্যবসায়িক অভিজাত শ্রেণির বিরাগভাজন হন তিনি। ক্ষমতা হারানোর পরেও তার দল নির্বাচন জিততে থাকে—২০০৭ ও ২০১১ সালে। তার বোন ইংলাকের সরকার থাকসিনকে সাধারণ ক্ষমা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়ায় অভিজাত গোষ্ঠী তা মানতে পারেনি। এরপর ২০১৪ সালে ইংলাককে আদালতের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করার পরপরই অভ্যুত্থান ঘটে।
বর্তমান রাজনীতিতে আশ্চর্য মোড় এসেছে গত বছর, যখন থাকসিনের দল ‘ফেউ থাই’ এবং সেনাসমর্থিত দলগুলো একত্রে জোট সরকার গঠন করে। এটাই থাকসিনের দেশে ফেরার পথ করে দেয়।
কিন্তু এখন অভিযোগ উঠেছে—তিনি ‘শান্ত জীবন’ যাপনের আশ্বাস দিয়ে ফিরে এসে আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে পড়েছেন। থাকসিন সিনাওয়াত্রা রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ, এমনকি পররাষ্ট্রনীতি নিয়েও ভূমিকা রাখছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিকল্প কী?
যদি পায়েতংতার্ন স্থায়ীভাবে বরখাস্ত হন, তাহলে সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন কেবল সেইসব রাজনীতিক, যাদের নাম গত নির্বাচনের আগেই মনোনয়ন তালিকায় ছিল।
এই অবস্থায় অনেকের দৃষ্টি এখন ‘ভূমজাইথাই’ দলের নেতা আনুতিন চর্ণভিরাকুলের দিকে। তিনি একসময় থাকসিনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তবে এখন নিজেই এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তি। তার দলই সম্প্রতি সরকার ছেড়েছে।
তবে সরকার গঠনের জন্য তার দরকার হবে অন্তত থাকসিনপন্থিদের বা ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া ‘পিপলস পার্টি’র সমর্থন।
‘পিপলস পার্টি’র নেতা নাট্থাফং রুয়েংপন্যাওয়ুত বলেছেন, তারা কেবল সেই প্রধানমন্ত্রীকেই সমর্থন করবেন, যিনি দ্রুত নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দেবেন। কিন্তু বর্তমান সংসদের বেশিরভাগ দল সেই ঝুঁকি নিতে চায় না, কারণ তারা আসন হারানোর আশঙ্কা করছে।
সেনাবাহিনী কী করবে?
এই জটিল রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেনাবাহিনীর সামনে এখন দুটি পথ—এক, থাকসিনপন্থি পপুলিস্টদের সঙ্গে আপস করা; দুই, পিপলস পার্টির উদারপন্থিদের সঙ্গে কাজ করা।
কিন্তু সেনাবাহিনী এ দুই পথই পছন্দ করে না। যে কারণে অনেকেই ভাবছেন, সেনাবাহিনী আবার পুরোনো পথেই হাঁটতে পারে, ঘটাতে পারে আরেকটি অভ্যুত্থান।
জিবি নিউজ24ডেস্ক//
 
                            
                             
                                                                                                
 
                                                                                                     
                                                                                                     
                                                                                                     
                                                                                                     
                                                                                                     
                                                                                                     
                                                                                                     
                                                                                                    
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন