জীবন বড় বৈচিত্রময়   মিজানুর রহমান মিজান 

gbn

একাদশ পর্ব- 

    আমি যখন স্কুলে যোগদান করি, তখন স্কুলে ছিলেন কর্মরত প্রধান শিক্ষক আব্দুছ ছোবহান খান ময়মনসিংহ,নিজাম উদ্দিন ময়মনসিংহ, আব্দুল ওয়াহিদ (খিজির ভাই), কমর উদ্দিন খান, বাবু নিহারেন্দু রায় মৌলভীবাজার,বাবু আশুতোষ চক্রবর্তী চন্ডিপুর,তপু চৌধুরী নবীগঞ্জ,মোস্তাফিজুর রহমান ও মাওলানা আব্দুল করিম প্রমুখ। 

  কমিটি প্লাস শিক্ষকদের সহিত প্রধান শিক্ষক আব্দুছ ছোবহান খান’র মধ্যে দুরত্ব তৈরী হচ্ছিল আমি যোগদান করার পূর্ব থেকেই।অত:পর তা ক্রমশ: বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ সময় স্কুলের প্রতিষ্টাকালীন সময় থেকেও দু:সময় অতিক্রান্ত করছিল বিধায় আমাকে স্কুলে নেয়া হয়।নানাবিধ সমস্যা জর্জরিত স্কুলটিকে পুনর্জন্ম তুল্য সজিবতা দান করা ছিল সময়ের সবচেয়ে জরুরী।স্কুল গৃহের বাঁশের তৈরী বেড়া হয়ে পড়েছিল জরাজীর্ণ, টিনের চালায় ধরেছে জং, হয়ে পড়েছে স্থানে স্থানে ছিদ্র যুক্ত।সর্বগ্রাসে আচছাদিত ছিল স্কুলের সার্বিক পরিস্থিতি।সুতরাং পরিচালনা কমিটি প্রধান শিক্ষকের পরিবর্তন বিষয়টি ত্বরান্বিত করেন। তাই বাধ্য হয়ে ৭/৯/৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রধান শিক্ষক আব্দুছ ছুবহান খান’র স্থলাভিসিক্ত হয়ে আসেন আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক হাজারী গাঁও নিবাসী জনাব মুহিবুর রহমান কিরণ।তিনি যোগদান করেন ৮/৯/৮১ খ্রিষ্টাব্দে।পাঠক এখানে দ্বিরুক্তির মতো আবারো আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আমার যোগদানের তারিখটি ৩/৬/১৯৮১ সাল।এ সময়কে উত্তর বিশ্বনাথ হাই স্কুল’র “চ্যালেঞ্জিং সময়” বললে অত্যুক্তি হবে না মোটেই।মুহিবুর রহমান কিরণের যোগদানে স্কুলে সার্বিক বিষয়ে শুরু হয় অগ্রযাত্রা।আরেকটু পরিষ্কার করে বললে বলতে হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে শিক্ষকবৃন্দ যে পরিমাণ কাজ করেছিলেন,উত্তর বিশ্বনাথ স্কুলের পুনর্জন্ম হয় আমাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় ১৯৮১ সাল থেকে আবারো।  

   স্যার যোগ দিয়েই শুরু করেন স্কুলের উন্নয়ন পরিকল্পনা।সাথে ছিল আমাকে প্রাপ্তি স্যারের জন্য সোনায় সোহাগ।অনুরুপ আমিও হয়েছিলাম উৎসাহিত, উদ্দীপ্ত স্যারকে পেয়ে। প্রথমেই হাত দেয়া হয় স্কুলের এক দশক পরে হলেও বার্ষিক অন্বেষা নামক ম্যাগাজিন প্রকাশ করা। যা স্কুলের প্রতিষ্ঠার পর এ প্রথম ম্যাগাজিন হয় ১৯৮২ সালের মার্চে মাসে প্রকাশিত।১৯৮১ সালের অক্টোবর এ ম্যাগাজিনের কাজ শুরু হলেও আলোর মুখ দেখে ১৯৮২ সালের প্রথমার্ধে। সাথে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় স্কুলের জন্য আর্থিক অনুদান সংগ্রহের লক্ষ্যে বিভিন্ন এলাকায় ধনী ব্যক্তির নিকট থেকে তহবিল গঠন। এ সময়ে সহযোগিতা কামনা করা হয় প্রাক্তন কিছু ছাত্রদের সাথে, এলাকার কিছু সংখ্যক শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের সাথে।।সে লক্ষ্য নিয়ে শুরু হয় যোগাযোগ।প্রায় দিনই স্কুল ছুটি দিয়ে শিক্ষকসহ প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্য থেকে দু’একজনকে সঙ্গে নিয়ে যেতাম বিভিন্ন গ্রাম বা এলাকায়।একদিকে ছাত্র সংকট, শিক্ষক স্বল্পতা, গৃহ সমস্যা, আসবাবপত্র সমস্যা, অর্থনৈতিক সমস্যা ইত্যাদি। 

    এদিকে পাশাপাশি চলছিল অন্যান্য পরিকল্পনাও। যেমন আর্থিক সংকট দুরীকরণে তহবিল সংগ্রহ জরুরী। আমরা শুরু করি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নিমিত্তে কাজকর্ম। গঠন করা হয়, “উত্তর বিশ্বনাথ সমাজ কল্যাণ সংস্থা”। এ সংস্থার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য স্কুলের উন্নয়ন।এক কথায় সংস্থার কাজকর্ম পরিচালিত হবে স্কুলের উন্নয়ন কেন্দ্রিক।লামাকাজী ও খাজাঞ্চি ইউনিয়নের তরুণ সম্প্রদায় ও প্রাক্তন ছাত্রদের করা হয় সদস্য। সংস্থার সভাপতি করা হয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক মুহিবুর রহমান কিরণ, সাধারণ সম্পাদক করা হয় হরিপুর নিবাসী স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষক আবুল কাহিরকে এবং আমি নির্বাচিত হই কোষাধ্যক্ষ রুপে।এলাকায় শুরু হয় তোলপাড়। সংস্থার সদস্য হবার। আমাদেরকে হিমশীম খেতে হয়। তাই সিদ্ধান্ত হয় ২০০ সদস্য সংখ্যায় সীমিতকরণ। অনেক তরুণ সেদিন সদস্য না হতে পেরে আক্ষেপে ভোগেন। চাঁদার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় প্রতি সদস্য দুই টাকা দিয়ে সদস্য হবার যোগ্যতা।কার্যকরী পরিষদে ছিলেন- মরহুম মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার, সাবেক চেয়ারম্যান ২নং খাজাঞ্চি ইউ/পি আব্দুন নুর,শায়েস্তা হোসেন, সমর কুমার দাস,তাজ উদ্দিন খান শিশু, মরহুম মুহিবুর রহমান, লিলু মিয়া, মোকাদ্দেছ আলী,কবির হোসেন কুব্বার,মরহুম আব্দুল জলিল খাজাঞ্চি গাঁও প্রমুখ। সে সময় প্রায় প্রতিদিনই চালনা করা হত অভিযান।স্কুল ছুটির পর এক কাপ চা পান করার কোন প্রকার ব্যবস্থা ছিল না। উপোষ অভিযানে রওয়ানা হতাম।কোন কোন দিন পিয়ন তাহির আলীকে রাজাগঞ্জ বাজার পাঠিয়ে এক সের চাল ও কিছু ডাল আনিয়ে একটি ডেকসিতে সব একত্রে রান্না করে মুঠো মুঠো করে খেয়ে নিতাম।পাঠক আপনারা হয়ত সংশয়ে ভোগবেন আরেকটু পরিষ্কার করে না বললে বিষয়টি। তাহির আলী একা মানুষ।তিনি একজনের পরিমাণে রান্না করার উপযোগি ডেগ, ডেগছি ছিল। এ ছোট হাড়ির পরিমাপ মতো ভাত ডাল একত্রে হত রান্না। স্কুলের শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক, আমি বাধ্যতামুলক, অন্যান্য শিক্ষকদের মধ্যে আশু বাবু বা অন্য একজন/দু’জন এবং বহিরাগতদের মধ্যে সমর বাবু, লিলু মিয়া, মোকাদ্দেছ আলী, শায়েস্তা হোসেন গংদের মধ্যে যেদিন যার সুবিধা অংশ নিতেন।বড় অভিযান হলে সবাই অংশ নিতেন। কখনও ছাত্র সংগ্রহ, কখনও ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে অনুপস্থিতি হলে বাড়ি বাড়ি অভিযান।এখানে একটি ছাত্র সংগ্রহের কথা উল্লেখ করতে চাই।আমরা সংবাদ পেলাম পঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণ হয়েছে একটি দরিদ্র পরিবারের সন্তান ক্লাসের প্রথম বালক হিসেবে।সে দারিদ্রতার কারনে স্কুলে ভর্তি হবে না। তাই আমাদের ঐদিন এগারোজনের কাফেলা রওয়ানা দিলাম ঐ ছাত্রের অভিভাবকের উদ্দেশ্যে বাড়ি অভিমুখে।পৌষ মাসের বিকেল বেলা। বাড়ির বাহিরে পেয়ে গেলাম ছাত্রের পিতাকে কর্মরত। শুরু হল কথোপকথন উভয়ের মধ্যে। অভিভাবকের এক কথা তিনির ছেলে স্কুলে দিবেন না। আর আমাদের কথা হল ছেলেটিকে স্কুলমুখী করা, স্কুলে আনা।শেষ পর্যায়ে ঐ অভিভাবকের জবাব ছিল,“ আমরা কেন এতো জোরাজোরি করছি তিনির পুত্রের জন্য। আমরা তিনির ছেলেকে দেখিয়ে কত টাকা খেয়েছি ইত্যাদি ইত্যাদি”।অভিভাবকের কথা শুনে সকলেই স্তম্ভিত, হতবাক। “যার লাগি করলাম চুরি, সে ডাকে গো চুর”গ্রামে প্রচলিত প্রবাদ বাক্যের মতো।  এগারোজনের মুখে কোন কথা নেই। সবাই যে যেখানে ছিলেন দাড়ানো সেখানেই বসে পড়েন। একটি পিনপতন নিরবতা করে বিরাজ।প্রায় দশ মিনিট পর নিরাশ ও হতাশার সচিত্রতা নিয়ে সেখান থেকে অপমানের বোঝা নিয়ে কেটে পড়ি।তবে আমরা হাল একেবারে ছাড়িনি।পরে অবশ্য ছেলেটি ভর্তি হয়েছিল বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ ও দেয়া হয়েছিল।তহবিল সংগ্রহের জন্য আমাদেরকে অনেক দুর পর‌্যন্ত যেতে হয়েছে। যেমন স্কুলের পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামের এক ধনাঢ্য ব্যক্তির সরণাপন্ন হলাম একটি ভবন করে দিতে। তিনি সম্মতও হলেন। তিনিকে দেয়া হল সংবর্ধনা।স্থাপিত হল ভিত্তি প্রস্তর।অতপর দিচ্ছি, দেব বলে করা হল কালক্ষেপণ।গ্রামে একটি প্রবাদ রয়েছে প্রচলিত,“ দেব বলে না দেয় না, একগুণ আছে না করে না”। এভাবে কয়েকটি মাস হয়ে যায় অতিবাহিত।খবর দিলে বা পেয়ে জিজ্ঞাসিলে একই কথা বার বার উচ্চারিত দিচ্ছি, দেব। শেষতক আষাঢ় মাসের ভরা জোয়ার বুক পানি ভেঙ্গে সাথে রয়েছে অঝোর ধারার বৃষ্টি এক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর রাজাগঞ্জ বাজার থেকে প্রধান শিক্ষক মুহিবুর রহমান কিরণ, আমি, আবুল কাহির,আব্দুল ওয়াহিদ খিজির মিয়া,সমর কুমার দাস ও শায়েস্তা হোসেন ভাটপাড়া হয়ে কাবিল যেতে তখন সড়কের চিহ্ন ছিল না। সে পথ ধরে সাঁতার কেটে গিয়ে হাজির হই ঐ ব্যক্তির বাড়ির সম্মুখে।তখন আমাদের এলাকায় মোটেই বিদ্যুৎ আসেনি। কিন্তু ঐ ব্যক্তির বাড়িতে ছিল ওয়াপদার বিদ্যুৎ।আমরা প্রত্যেকের হাতে ছাতা রয়েছে এবং প্রত্যেকের পরিধেয় পেন্ট হাঁটু অবদি গুটানো।এ অবস্তায় আমাদেরকে দেখে মানুষ শুরু করে উচ্চ:স্বরে “ডাকাত, ডাকাত” শব্দটি উচ্চারণে শোরগুল।আমরা সবাই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি। চতুর্দিক থেকে মানুষ বিভিন্ন প্রকার অস্ত্র নিয়ে এগুতে থাকে। আমরা নিরুপায় হয়ে ঠায় দাড়িয়ে থাকি। এমতাবস্তায় প্রায় মিনিট দশেক পর মানুষের চিৎকার একটু কমে আসে। তখন আমরা পরিচয় দিতে সক্ষম হই এবং ঐ ব্যক্তি বেরিয়ে এসে আমাদেরকে তিনির গৃহে বসতে দেন।(চলবে) 

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন