দেলোয়ার জাহিদ ||
৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক যে তীব্র বৈরিতার দিকে গড়িয়েছে, তা সাম্প্রতিক ইতিহাসে গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন নতুন নয়; তবে এবারের পরিবর্তনের সঙ্গে যে বিষয়টি বিশেষভাবে সামনে এসেছে, তা হলো—প্রচণ্ড ভারতবিরোধী মনোভাবের উত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটি ন্যারেটিভকে পরিকল্পিতভাবে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। এই পরিবর্তনকে সরাসরি সামরিক অভ্যুত্থান বা প্রকাশ্য শক্তি প্রয়োগ হিসেবে দেখা না গেলেও, এর পেছনে একটি সুপরিকল্পিত ভূরাজনৈতিক নকশার ইঙ্গিত স্পষ্ট।
বর্তমানে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক এমন এক বিপজ্জনক সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছে, যেখান থেকে কূটনৈতিকভাবে ফিরে আসার পথ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। এখনো হয়তো এটি পুরোপুরি ‘প্রত্যাবর্তন-অযোগ্য পর্যায়’ অতিক্রম করেনি, তবে সেই সীমারেখা যে অত্যন্ত নিকটবর্তী—তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মিডিয়াযুদ্ধ, সীমান্ত সহিংসতা, ভিসা জটিলতা ও বাণিজ্য স্থবিরতা পারস্পরিক আস্থাকে মারাত্মকভাবে ক্ষয় করেছে। ভারতের কৌশলগত অবস্থান বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাবকে আরও উসকে দিয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ তৃতীয় দেশের কূটনৈতিক তাগিদের ফলে জুন মাস থেকে পরিস্থিতিতে আংশিক মোড় দেখা যায়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এজেন্সি নির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে এসে সরাসরি বাংলাদেশ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নেন। অজিত দোভাল ও ড. খলিলুর রহমানের বৈঠক সেই প্রেক্ষাপটে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস হিসেবে বিবেচিত হয়। সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক পুনর্গঠনের বার্তায় দুই দেশের কূটনৈতিক যোগাযোগ পুনরায় সক্রিয় হলেও আস্থার সংকট এখনো পুরোপুরি কাটেনি।
একপর্যায়ে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক এমন এক সংক্রমণকালীন সীমারেখায় পৌঁছেছিল, যেখানে প্রতিটি ভুল সিদ্ধান্ত সম্পর্ককে ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’-এর দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। কূটনীতির পরিসর সংকুচিত হয়ে যখন আবেগ ও এজেন্সিনির্ভর অবস্থান প্রাধান্য পায়, তখন পারস্পরিক আস্থা প্রায় অপরিবর্তনীয়ভাবে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উদ্যোগগুলো তাই কেবল সৌহার্দ্যের প্রতীক নয়; বরং এটি একটি সুস্পষ্ট নীতিগত সতর্কবার্তা—সমতা ও সংলাপের ভিত্তিতে সম্পর্ক পুনর্গঠন না হলে ভবিষ্যতে সংশোধনের সুযোগ নাও থাকতে পারে।
বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক কার্যত ‘প্রত্যাবর্তন-অযোগ্য পর্যায়’-এর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিল। মিডিয়াযুদ্ধ, সীমান্ত উত্তেজনা এবং কূটনৈতিক স্থবিরতা এমন মাত্রায় আস্থাকে ক্ষয় করেছিল যে, সময়মতো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না এলে এই সম্পর্ক দীর্ঘমেয়াদে কাঠামোগতভাবে ভেঙে পড়তে পারত। সাম্প্রতিক কূটনৈতিক তৎপরতাগুলো তাই সম্পর্ক উন্নয়নের চেয়ে বেশি কিছু—এটি একটি সম্ভাব্য কৌশলগত বিপর্যয় প্রতিরোধের জরুরি প্রয়াস। এর ব্যর্থতা দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপর গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু রাষ্ট্র রাশিয়ার অবস্থান বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। ঢাকায় নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার গ্রিগোরিয়েভিচ খোজিন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিরাজমান উত্তেজনা দ্রুত প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছেন। ঢাকায় রুশ দূতাবাসে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়া উচিত। একই সঙ্গে তিনি স্পষ্ট করেন, রাশিয়া কোনো ধরনের মধ্যস্থতা বা হস্তক্ষেপ করবে না, তবে পরিস্থিতি যাতে আরও জটিল না হয়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে সতর্ক করেন।
রাষ্ট্রদূত খোজিন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষিত তফসিলকে স্বাগত জানিয়ে নির্ধারিত সময়—১২ ফেব্রুয়ারি—নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন এবং নির্বাচন-পূর্ব সময়ে দেশে শান্তিপূর্ণ ও অনুকূল পরিবেশ বজায় থাকার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
রাশিয়ার এই বক্তব্য আঞ্চলিক কূটনৈতিক ভারসাম্য, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের প্রতি এক সংযত ও নীতিনির্ভর অবস্থানের প্রতিফলন। এতে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ পেলেও, একই সঙ্গে সার্বভৌমত্ব ও দ্বিপক্ষীয় সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান সুস্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
এই মুহূর্তে মূল প্রশ্ন একটাই—বাংলাদেশ ও ভারত কি এই সংকটময় সন্ধিক্ষণে প্রয়োজনীয় কৌশলগত সংযম ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দেখাতে পারবে, নাকি আস্থাভাঙনের এই চূড়ান্ত সীমা সত্যিকার অর্থেই সম্পর্ককে কূটনৈতিকভাবে প্রত্যাবর্তন-অযোগ্য পথে ঠেলে দেবে? সিদ্ধান্তের সময় এখনই।
______________
দেলোয়ার জাহিদ, স্বাধীন রাজনীতি বিশ্লেষক, মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশ নর্থ আমেরিকান জূর্নালিস্ট নেটওয়ার্ক এর সভাপতি (এডমন্টন, আলবার্টা, কানাডা)

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন