দেশ-মাতৃকার কল্যাণে ওসমান হাদি নামের ফুলটি কেবল ফুটতে শুরু করেছিল
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।
হাদিকে যদি দলের চোখ দিয়ে দেখেন, তবে আপনি ভুল করছেন। হাদি কোনো দলীয় স্লোগান নয়, কোনো রাজনৈতিক পোস্টার নয়— হাদি রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের সম্পদ। তিনি এমন একজন মানুষ, যাঁকে কোনো নির্দিষ্ট ঘটনার ভেতরে আটকে দিলে ইতিহাস সংকুচিত হয়ে যায়। ওসমান হাদি আসলে একটি অবস্থান— যেখানে আপস নেই, ভয় নেই, দ্বিধা নেই। যে সমাজে সত্য বলা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেখানে সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো মানুষ স্বাভাবিকভাবেই একা হয়ে পড়ে। হাদিও একা ছিলেন। কিন্তু তাঁর একাকীত্ব ছিল দায়িত্বশীল, সচেতন এবং আত্মমর্যাদায় পূর্ণ।
দেশ-মাতৃকার কল্যাণে ওসমান হাদি নামের ফুলটি কেবল ফুটতে শুরু করেছিল। পুরোপুরি বিকশিত হওয়ার আগেই তার সুবাস ছড়িয়ে পড়েছিল ৫৬ হাজার বর্গমাইলের অলিগলি জুড়ে। ঘরে ঘরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল এক তরুণের কণ্ঠ— যে কণ্ঠ ঘুমন্ত বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছিল। সীমান্ত শরীফ কাঁপুনি ধরিয়েছিল সীমান্তের ওপারের শত্রুদের বুকেও। কিন্তু ইতিহাসের পুরোনো নিয়ম— যে আলো বেশি উজ্জ্বল হয়, তাকেই আগে নিভিয়ে দিতে চায় অন্ধকার।
হাদিকে বাঁচতে দেওয়া হয়নি। কারণ হাদিরা বাঁচলে সুবিধাবাদীদের মুখোশ খুলে পড়ে। কাপুরুষেরা চিরকাল সামনে থেকে সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পেয়েছে। তারা আদর্শকে দমিয়ে দিতে চেয়েছে পেশিশক্তির প্রয়োগে। যুগে যুগে তারা পেছন থেকেই ষড়যন্ত্র চালিয়েছে, আড়াল থেকে চোরাগোপ্তা আঘাত হেনেছে। যারা সত্যকে ভয় পায়, দেশপ্রেমের মধ্যে নিজেদের বিপন্নতা দেখে— তারা হাদিদের বিরুদ্ধে যাবেই। অথচ হাদিরা তো শতাব্দীতে এক-আধবারই আসে। আসে অন্যায়, অনৈতিকতা আর অবৈধতার সাজানো বন্দোবস্ত দুমড়েমুচড়ে দিতে। শুধু স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষান্ত হয় না, স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথও দেখিয়ে দেয়। এই কারণেই তাদেরকে থাকতে দেওয়া হয় না, বাঁচতে দেওয়া হয় না।
হাদিকে হত্যাযোগ্য করে তোলার দায় কেবল প্রকাশ্য শত্রুদের নয়। বিপক্ষের মতো পক্ষের অনেকেও এই দায় এড়াতে পারে না। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য হাদিকে একাই বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে হয়েছে। বলতে হয়েছে কোটি মানুষের না-বলা কথা। অথচ আমরা প্রত্যেকে যদি যার যার জায়গা থেকে ন্যায়ের কথা বলতাম, অধিকার ও ইনসাফের পক্ষে দাঁড়াতাম— তবে হাদি আলাদা করে টার্গেট হতো না। তখন হাদির কণ্ঠ রাষ্ট্র ও সমাজের স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর হিসেবেই বিবেচিত হতো। শত্রুও তার মস্তিষ্ককে বারুদের লক্ষ্যবস্তু বানানোর সুযোগ পেত না।
আমাদের দেশপ্রেম ছিল শর্তসাপেক্ষ, দলীয় ব্র্যাকেটে বন্দী। হাদির দেশপ্রেম ছিল দল-মতের ঊর্ধ্বে ওঠা এক অকৃত্রিম দায়বদ্ধতা। হাদি আমৃত্যু আধিপত্যবাদের বিরোধিতা করেছে। লড়াই করেছে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য। জানের শত্রুকেও দিতে চেয়েছে ন্যায্যতার সুযোগ। যে ইনকিলাবের কথা সে বলেছে, তা কোনো আবেগী স্লোগান ছিল না— ছিল সুস্পষ্ট নৈতিক অবস্থান। রাজপথে হেঁটেছে, মানুষের দুয়ারে গেছে, মসজিদে দাঁড়িয়েছে—সবখানেই সত্যকে উঁচু করতেই গেছে।
হাদি আমার চেয়ে বয়সে বড় কি না জানি না; তবে ক্লাসে এক ধাপ উপরে ছিল—একাদশ-দ্বাদশ। মেধায়—আল্লারে আল্লাহ! যোজন যোজন ফারাক। সত্য দেখার ক্ষেত্রে হয়তো আমরা কাছাকাছি; কিন্তু সত্যকে সত্য বলার সাহসে হাদি নক্ষত্রের সমকক্ষ— যেখানে আমি বালুকণাও নই। এখান থেকেই স্বীকার করি— হাদির জীবনকে ঈর্ষা হয়, মরণকেও।
আমার মৃত্যু হলে কতজন কাঁদবে? হিসেব করে দেখেছি— বড়জোর চারজন, তাও যদি বাবা-মা তখনো বেঁচে থাকেন। আর হাদির জন্য কাঁদছে কতজন? কয়েক কোটি। হাদির জন্য দোয়া করছে কতজন? অগণিত। তার সুস্থতার জন্য, তার বেঁচে থাকার আশায় সমগ্র দেশ একসাথে দাঁড়িয়েছে। এই ভালোবাসা ক’জনের ভাগ্যে জোটে? হাদি কেবল একজন মানুষ ছিল না— হাদিই বাংলাদেশ। তার বুক বাংলাদেশের হৃদয়।
হাদির মা এবং হাদির সন্তানের মায়ের কথা ভাবলে বুক ভারী হয়ে আসে। সন্তান ফিরবে, সন্তানের বাবা ফিরবে— এই আশায় দুই মায়ের এক সপ্তাহের অপেক্ষা আর আমাদের এক সপ্তাহ এক জিনিস নয়। চোখের পানি, মনের আকুতি আর প্রার্থনার শক্তিকে ছাপিয়ে তাদের দুনিয়ায় নেমে এসেছে এমন অন্ধকার, যা রাতের অন্ধকারকেও হার মানায়। হাদি ভাইয়ের ছেলেটা যেদিন বাবার শূন্যতা বুঝবে, সেদিন বাংলাদেশ হাদি-পুত্রকে কী কৈফিয়ত দেবে?
আমি স্বীকার করি— আমি বিড়ালের মতো পাঁচশ বছর বাঁচতে চাই। সিংহের মতো দুই মিনিট বাঁচার সাহস আমার নেই। কালোকে কালো বলার যে সৎসাহস, তা আমার মধ্যে নেই। শক্তের ভক্ত, নরমের যম হয়ে বাঁচি। আমাকে দুই টাকায় কেনা যায়। অথচ হাদিকেও কেনা যেত— কিন্তু টাকায় নয়, ভালোবাসায়। এখানেই হাদির শ্রেষ্ঠত্ব, এখানেই আমাদের লজ্জা।
হাদি কি হারিয়ে যাবে? কখনোই না। মানুষকে হত্যা করা যায়, কিন্তু মতবাদকে হত্যা করা যায় না। হাদিবাদ অমর। ইতিহাসের পরতে পরতে যতদিন জুলুম থাকবে, আধিপত্যবাদের আগ্রাসন থাকবে এবং সত্য থাকবে— ততদিন হাদি বাঁচবে। একজন হাদিকে হত্যা করা মানে হাজার হাজার হাদির জন্মের বীজ বপন করা।
তেত্রিশ বছরের জীবনে দেশপ্রেমের প্রশ্নে হাদি যে ইমপ্যাক্ট রেখে গেছে, সেটাই তার সফলতা। কাপুরুষের মতো শত বছর বেঁচে থাকার মধ্যে কোনো গৌরব নেই। ইতিহাসের প্রত্যেকটি হাদি ক্ষণজন্মা— কিন্তু সেই ক্ষণ দিয়েই তারা যুগ তৈরি করে। তাদের কবরে পাঠানো যায়, কিন্তু তাদের জ্বালিয়ে যাওয়া সত্যের বারুদ নেভানো যায় না।
হাদির মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়— রাষ্ট্র শুধু একটি মানচিত্র নয়। রাষ্ট্র গড়ে ওঠে কিছু মানুষের রক্ত, সাহস আর নৈতিক দৃঢ়তার ওপর। যারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মাথা নত করে না। যারা জানে— জীবন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু দায়িত্বের হিসাব ইতিহাস রাখে।
সবচেয়ে করুণ বাস্তবতা হলো— হাদির সন্তানেরা আর বাবাকে ফিরে পাবে না, তার মা আর সন্তানকে। এই শূন্যতার কোনো রাষ্ট্রীয় ক্ষতিপূরণ নেই। তবুও রাষ্ট্র পেয়েছে এক অনিবার্য প্রশ্ন: আমরা কি এমন মানুষদের কেবল স্মরণ করব, নাকি তাদের আদর্শ বাঁচিয়ে রাখব? ওসমান হাদিকে গুলি করেছে পশুত্ব, কিন্তু তাকে হত্যা করতে পারেনি। কারণ যারা সত্যের পক্ষে জীবন দেয়, তারা মৃত্যুর পর বিবেক হয়ে ফিরে আসে।
এই জায়গায় এসে নিজের দিকে তাকালে লজ্জা লাগে। আমি আবার বলি— হাদির জীবনকে ঈর্ষা হয়, মরণকেও। কারণ সে যেভাবে বেঁচেছে, তাতে আপস নেই; আর যেভাবে মরেছে, তাতে পরাজয় নেই। আমি দীর্ঘ জীবন চাই, নিরাপদ জীবন চাই। হাদি চেয়েছিল অর্থবহ জীবন। এখানেই সে মহান, এখানেই আমরা ক্ষুদ্র।
হাদির জীবন প্রমাণ করে— জীবনের দৈর্ঘ্য নয়, জীবনের ওজনই আসল। সে বেঁচে আছে প্রার্থনায়, বেঁচে আছে তরুণদের চোখে, বেঁচে আছে সেই প্রশ্নে— আমরা কীভাবে বাঁচব? নীরবে, আপসে, না কি সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে?
হাদির মতো হওয়া সবার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু হাদির মতো না হওয়াটাই আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন