রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।
আপনি যদি নিয়মিত বইপত্র পড়েন, চোখ-কান খোলা রেখে জীবনকে পর্যবেক্ষণ করেন- তবে নিশ্চিতভাবেই এক ধরণের সমস্যার মুখোমুখি হবেন। এই সমস্যাকে একদিকে পাঠের শক্তি আবার অন্যদিকে জ্ঞানের দুর্বলতাও বলা যায়। সমস্যাটা হলো— আপনি যত বেশি পড়বেন, ততই একা হতে শুরু করবেন। তখন কাউকেই আর অন্ধভাবে অনুসরণ করতে পারবেন না। আপনার মনে বারবার প্রশ্ন জাগবে, অন্ধ অনুকরণে দিন শেষ হবে না।
জ্ঞানের পাঠশালায় প্রবেশের পর এমন সব সত্য প্রকাশ করে দিবেন যা আপনাকে অন্যদের কাছে অপ্রিয় করে তুলবে। এমন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাবেন, যেখানে সঙ্গী-বন্ধুর সঙ্গ জমবে না। আলোকে ভালো এবং মন্দকে কালো বলার যে প্রবাহ আপনার থেকে প্রবাহিত হবে তা অনেকের মুখকে অন্ধকারে ছেয়ে দেবে। তখন আপনাকে অপছন্দ করা মানুষের সংখ্যা বাড়বে। অসৎ বন্ধু ছেড়ে যাবে। আত্মীয়-স্বজন দুর্নাম ছড়াবে।
আপনার সমালোচনা জোড়ালো হবে। যখন কোনোভাবেই আপনার গতিরোধ করা যাবে না তখন চরিত্রহননের মতো জঘণ্য পথ বেছে নেবে শত্রুপক্ষ। আপনি যে প্রশ্ন করেন, খুঁত ধরিয়ে দেন তা ক্ষমতাশালীরা সহ্য করবে না। আপনি যে প্রশ্নাতীত আনুগত্য প্রদর্শন করেন না, মাথা নত করে রাখেন না- তা দানবদের দুনিয়ায় চরম বেয়াদবি হিসেবে সাব্যস্ত হয়। তখন আপনাকে দমিয়ে রাখতে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করবে। প্রয়োজনে পথের কাঁটা উচ্ছেদ করতে ঢাল-তলোয়ার ব্যবহৃত হবে।
বই, সাময়িকী কিংবা যেকোনো চিন্তাশীল পাঠ্যের সাথে আপনার সম্পর্ক গভীর হলে আপনার চিন্তার জগত বিস্তৃত হতে থাকে। আপনি না চাইতেই আপনার ভাবনার দৃষ্টিভঙ্গি, বলার ধরন, জীবনবোধ কিংবা রুচি— সবকিছুই নতুন রূপে রূপান্তরিত হতে শুরু করবে। পাঠের শক্তি আপনাকে ধীরে ধীরে একটি স্বতন্ত্র সত্তায় পরিণত ও বিকশিত করবে। আর সেই পর্যায়ে গিয়ে দেখবেন— আপনি অনেকটা একা হয়ে গেছেন। নিঃসঙ্গ শেরপা হয়ে বইয়ের মধ্যে জেগে আছেন। আশেপাশের অনেকের সাথে আর আগের মতো বনিবনা মিলছে না। যার-তার সাথে কথা বলার ইচ্ছাও দিন দিন মরে যাচ্ছে।
সবাই যা দেখে, সবাই যা বোঝে আপনার বোঝার ধরন তার সঙ্গে মিলছে না। আপনার দর্শন, মত, অবস্থান— সবকিছুই যেন অন্য ছন্দে হাঁটছে। সমাজ এটিকে কখনো বিচিত্রতা, কখনো বাতিক বলে পাশ কাটিয়ে দিতে চাইবে। অনেকে বুঝতেই পারবে না যে আপনি এক ভিন্ন জগতে যাতায়াত করছেন— যেখানে নিয়মিত মতের সংঘাত হয়, প্রশ্নের জন্ম হয় এবং ভাবনার গভীরতা বেড়ে যায়। আপনি পরিদৃশ্যমান জগতের বাইরেও দেখতে শুরু করেন।
জ্ঞানের সাথে যত সময় গড়াবে, সম্মন্ধে জড়াবে- আপনার অতীতের অনেক কিছুই তত ফ্যাকাশে মনে হবে। শৈশব-তারুণ্যের পছন্দ, প্রিয় নায়ক-গায়ক, প্রিয় খেলোয়াড়— সবকিছুকেই আপনি নতুন আলোয় দেখতে শুরু করবেন। বই আপনাকে বহুস্তরীয়ভাবে ভাবতে বাধ্য করে। ফলে যাদেরকে একসময় পছন্দ করতেন বা আদর্শ ভাবতেন, তাদের বিষয়ে আপনার অবস্থানও বদলে যেতে পারে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করদে থাকবেন নিজেকে।
এই পরিবর্তনই আসলে আপনার বিকাশের সৌন্দর্য। যে মানুষের জীবনের পঠন-পাঠ আছে, বই আছে- সে কোনোকিছুতেই অন্ধ হতে পারে না। লোভ-মোহ, প্রেম-প্রলোভন তাকে বধির করতে পারে না। কেউ তাকে অন্ধ সমর্থনের দিকে কোথাও ঠেলে দিতে পারে না। চিন্তা তাকে নতুন মত, নতুন ব্যাখ্যা এবং নতুন দর্শন গড়তে অনুপ্রাণিত করে।
সারা জীবন পাঠের সাধনা করুন। যে পড়ে, সে-ই গড়ে। পাঠাভ্যাসের কোনো অবসর নেই। শেখার মধ্যেই বিশ্রামের আনন্দ। পাঠ যদি নেশায় পরিণত হয় তবে আজ যে বিষয় অসাধারণ মনে হচ্ছে— কয়েক বছর পর তা অসার মনে হতে পারে।
নিজের মধ্যে আলো জ্বালাতে পড়ার সক্ষমতা অর্জনের বিকল্প নেই। অর্থ-সম্পত্তি জ্ঞানের বিকল্প নয়। বরং দীনতাই জ্ঞান অর্জনের যোগ্য সঙ্গী। বই-বিমুখ জাতি কখনো সঠিক পথ খুঁজে পায় না। আর যারা পড়তে পড়তে জীবন কাটাতে পারে— তাদের মৃত্যু পর্যন্ত শেখার আনন্দ থেমে থাকে না। নতুনকে জানার যে আনন্দ তা অন্যকিছুতেই মেলে না।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন