জ্যোৎস্নার শহরে ‘হৃদয় ভাঙার শব্দ’   কবি মমিনুল মউজদীনের প্রয়াণে এখনও কাঁদে সুনামগঞ্জ

gbn

আনোয়ার হো‌সেন র‌নি||ক‌বি সাংবা‌দিক ||

জল-জ্যোৎস্নার শহর সুনামগঞ্জ আজও কাঁদে। কাঁদে হারিয়ে যাওয়া এক প্রিয় মুখের জন্য, যার অনুপস্থিতি শহরের আকাশ থেকে মুছে দিয়েছে বহু আলো, বহু প্রাণ। যেন রাতের জ্যোৎস্না আর নেমে আসে না তেঘোরিয়ার পথঘাটে, বাসার ছাদে বসে না জ্যোৎস্না দেখার প্রতিযোগিতা, নেই সেই সাহিত্য আড্ডার উচ্ছ্বাস, নেই কবিতার শহরের কবি।

সুনামগঞ্জের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনকে সমান দৃঢ়তায় আলোকিত করে যাওয়া কবি মমিনুল মউজদীন আজ ইতিহাসের পাতায়, মানুষের স্মৃতির গভীরে। তার মৃত্যুদিনে আজও শহরজুড়ে শোনা যায়—‘হৃদয় ভাঙার শব্দ’। যেন ভেঙে যায় একটি শহরের সত্তা, এক প্রজন্মের স্বপ্ন, এক রাজনৈতিক মানবিকতার রূপকথা। রোমান্টিকতার ভেতর প্রতিবাদের আগুন সত্তর দশকের রোমান্টিক কবিদের ধারা বাংলা সাহিত্যকে যে এক ধরনের আবেগ, স্পন্দন ও স্বপ্ন দেখিয়েছিল—তারই একটি উজ্জ্বল প্রতিফলন ছিলেন কবি মমিনুল মউজদীন। তার কবিতায় ছিল প্রকৃতি, প্রেম, বিদ্রোহ, মানবিকতা আর আত্মমুক্তির গভীর আকাঙ্ক্ষা।

আধুনিক বাংলার চলমান স্পন্দনের সঙ্গে মিলেমিশে তার রোমান্টিকতার ভেতর ফুটে উঠত ষাট–সত্তরের প্রতিরোধী চেতনাও।রাজনীতি করলেও তার স্পৃহা কখনও ক্ষমতার আভিজাত্য বা পুঁজিবাদের শীতল ছায়ায় ঢেকে যায়নি। তিনি ছিলেন হৃদয়ের রাজনীতিবিদ—মানুষের জন্য, মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য লড়ে যাওয়া এক স্বপ্নবান কর্মী। সামন্ত অহংকারকে অতিক্রম করে মানবিকতার রাগে-তালে বারবার উচ্চারিত হতো তার কণ্ঠস্বর।

সাহিত্য–সংস্কৃতির হাতে হাত রেখে রাজনীতিতে পদযাত্রা মমিনুল মউজদীনের রাজনৈতিক জীবনের শুরু ছাত্রাবস্থায়। নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হন। সেই থেকে শহরের মিছিল-সমাবেশ তার পরিচিত পথ হয়ে ওঠে। ১৯৭৪ সালে যোগ দেন জাসদ ছাত্রলীগে। একই সঙ্গে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন নিয়েও সক্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। সুনামগঞ্জে গড়ে তোলেন ‘তরুণ সাহিত্যসেবী’ নামের সংগঠন, যা পরবর্তীকালে শহরের সংস্কৃতি–চর্চার একটি উর্বর ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায়।

স্বৈরশাসনের সময় তিনি ছিলেন সম্মুখসারির যোদ্ধা। কলমে–কণ্ঠে প্রতিবাদ করেছেন,লিখেছেন স্বৈরাচারবিরোধী কবিতা। রাজপথ আর কবিতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গড়ে তুলেছিলেন এক প্রখর মানবিক বোধ, যা তাকে সুনামগঞ্জের মানুষের কাছে করে তুলেছিল অতি আপন।

হাছন রাজাকে বিশ্বে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ মরমী সাধক হাছন রাজা শুধু সুনামগঞ্জের ইতিহাস নয়, বাংলার মরমী ধারা ওলোকসংস্কৃতির এক মূল্যবান অধ্যায়। এই অধ্যায়কে দেশ–বিদেশের মানুষের কাছে পৌছে দিতে কবি মমিনুল মউজদীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তার উদ্যোগেই হাছন রাজা নিয়ে গবেষণা, উৎসব ও আলোচনা নতুনমাত্রা পায়। বিশেষ করে হাছন লোক উৎসব তাকে সুনামগঞ্জের সংস্কৃতি-আন্দোলনে অনন্য উচ্চতায় দাঁড় করায়।

তার প্রচেষ্টায় হাছন রাজার গানের আবেদন ছড়িয়ে পড়ে জাতীয় পর্যায়ে। সেবামূলক রাজনৈতিক নেতৃত্ব সুনামগঞ্জ পৌরসভার নেতৃত্বেও তিনি ছিলেন দৃশ্যমান। ১৯৯৩ সালের পৌর নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর সুনামগঞ্জ শহরের অবকাঠামো, সংস্কৃতি ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। মানবিক নেতৃত্ব ও সৎ-শাসন তাকে দ্রুতই জনপ্রিয় করে তোলে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ ও ২০০৪ সালে আরও দু’দফা পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। তার প্রশাসনিক নীতিতে ছিল— “মানুষের পাশে থাকা, তাদের সমস্যার সমাধান করা এবং সংস্কৃতির চর্চাকে উজ্জীবিত রাখা।” এই কার্যকর নীতি তাকে মানুষের কাছে ‘আপন জন’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।

জ্যোৎস্নার কবি—কাব্যচর্চা ও প্রকাশনা মমিনুল মউজদীনের সাহিত্যচর্চা জীবনব্যাপী। তার কাব্যগ্রন্থ ‘এ শহর ছেড়ে পালাবো কোথায়’ প্রকাশিত হয় মৃত্যুর কিছু আগে। তার লেখায় শহর–প্রকৃতি–মানুষ—সবকিছুই অন্যরকম এক রোমান্টিক আবেশে মিশে আছে। ২০০৭ সালে মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় আরেক কাব্যগ্রন্থ— ‘হৃদয় ভাঙার শব্দ’। কবিতার ভেতরে ছিল শহরের স্মৃতি, প্রেমের ভাঙন, মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসা এবং জীবনের চূড়ান্ত নির্মোহ উপলব্ধি।

তার কবিতার সবচেয়ে পরিচিত পংক্তি— “এ শহর ছিন্নভিন্ন করে গেছো তুমি…”এখনো সুনামগঞ্জের তরুণদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, ঠিক যেমন তার মৃত্যুর পর শহর ভর করেছে নীরবতার বিষাদে।

জন্ম, পরিবার ও শিকড়ের গল্প ১৯৫৫ সালের ২৯ আগস্ট সুনামগঞ্জ শহরের তেঘোরিয়া গ্রামে জন্ম নেন তিনি। নয় ভাই–পাঁচ বোনের বড় পরিবারে তার জন্ম-শৈশব কাটে। মাতা সৈয়দা শামসুন্নাহার খাতুন, আর পিতা দেওয়ান রাজা চৌধুরী ছিলেন মরমী সাধক হাছন রাজার পৌত্র। এই পারিবারিক শিকড়ই তাকে মরমী পথ ও মানবিক চিন্তার গভীরে নিয়ে যায়। শিক্ষাজীবন, রাজনীতি, সাহিত্য—সব ক্ষেত্রেই ছিলেন মেধাবী, পরিশ্রমী এবং অস্থির আত্মঅন্বেষী। তার সমসাময়িকরা বলেন— “মউজদীন ছিলেন এক হাতে রাজনীতি, অন্য হাতে কবিতা নিয়ে হাঁটা মানুষ।”

অকাল মৃত্যুর কালো দিন ২০০৭ সালের আজকের এই দিনটি সুনামগঞ্জবাসীর হৃদয়ে গভীর ক্ষত হয়ে আছে। সেদিন স্ত্রী-পুত্রসহ এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিনি। বড় ছেলে ফিদেল নাহিয়ান গুরুতর আহত হলেও পরে সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং আজও বাবার স্বপ্ন ও আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করে চলেছেন।

কবি, নেতা, সমাজসেবী—সব পরিচয় ছাপিয়ে মমিনুল মউজদীন ছিলেন সুনামগঞ্জের মানুষের হৃদয়ের মানুষ। তার মৃত্যুর সংবাদে শহরজুড়ে নেমে এসেছিল এক বর্ণনাতীত শোক। আজও সেই শোক ভুলে যেতে পারেনি শহরবাসী। স্মৃতির আলোয় ফিরে দেখা সুনামগঞ্জ আজ সুনামগঞ্জের রাস্তায় হাঁটলে অনেকেই বলেন—“জ্যোৎস্নার শহর আজও জ্যোৎস্নাহীন।”

কারণ মমিনুল মউজদীন ছিলেন সেই আলো, যাকে ঘিরে তরুণরা জড়ো হতো, মানুষের সমস্যা নিয়ে আলোচনার টেবিল বসত, সাহিত্য আসর জমত। এখনো পৌর মার্কেটের আশেপাশে সেই আড্ডাস্থলগুলো তার স্মৃতি বহন করে। তার অনুসারী তরুণরা বলেন—“তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন—মানুষের পাশে দাঁড়ানোই সবচেয়ে বড় রাজনীতি।” অমর হয়ে থাকা এক আলোকিত নামসময় পেরিয়ে গেলেও সুনামগঞ্জের মানুষ ভুলে যায় না তার হাসিমাখা মুখ, তার দৃঢ়তা, মানবিকতা, এবং কবিতার স্নিগ্ধ আলো।

রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাইরে দাঁড়িয়েও তাকে ভালোবাসতেন সাধারণ মানুষ। তিনি ছিলেন শহরের আত্মার সঙ্গে জড়ানো এক নাম। আজও শহরের অনেক বাড়ির ছাদে জ্যোৎস্না নেমে এলে কেউ কেউ বলেন—এই আলোয় ভেসে বেড়ান কবি মমিনুল মউজদীন।”কবি নেই, কিন্তু তার লেখা, তার স্বপ্ন, তার উদ্যোগ, তার আন্দোলন—সবকিছুই সুনামগঞ্জকে আজও আলোকিত করে যায়।

স্মৃতির অন্তরালে দাঁড়িয়ে তিনি যেন বলছেন— “জ্যোৎস্নার শহরকে ভালোবাসো, ভালোবাসো মানুষকে। জল-জ্যোৎস্নার শহর সুনামগঞ্জের সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও মানবিকতার ইতিহাসে কবি মমিনুল মউজদীন এক অনিবার্য নাম। তার মৃত্যু এক শহরের হৃদয় ভেঙেছে, কিন্তু তার স্বপ্ন—অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম, মানুষের পাশে দাঁড়ানো, সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দেওয়া—আজও বেঁচে আছে এই শহরের আকাশে। নিয়ন আলো ভেদ করে যে জ্যোৎস্না আজও সুনামগঞ্জবাসী দেখে—তার প্রতিটি ক্ষীণ আলোয় ভেসে বেড়ান কবি মমিনুল মউজদীন।

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন