হাসিনার মৃত্যুদণ্ড দ্রুত কার্যকর করতে হবে-শহীদদের পরিবারের প্রতিক্রিয়া

gbn

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে দ্রুত রায় কার্যকর দেখতে চান জুলাই আন্দোলনে আহত ও শহীদদের স্বজনরা। তাদের দাবি, এ রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে যেন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। এর ফলে আর কোনো স্বৈরশাসকের যেন উত্থান না হয়। সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর শহীদদের স্বজনরা গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এ সময় তারা বলেন, রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচারের দরজা খুলেছে। এখন সবচেয়ে বড় বিষয় হবে রায় কার্যকর করা। তাদের সাফ কথা-হাসিনা যেখানেই লুকিয়ে থাকুক, তাকে দ্রুত দেশে এনে রায় কার্যকর করতে হবে।

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় শহীদ মীর মুগ্ধর বাবা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এ রায় সঠিক দিকে যাওয়ার একটি পদক্ষেপ। তবে এটি কেবল শুরু। শুধু আমার পরিবার নয়, শহীদপরিবারগুলোর প্রত্যাশা-দোষীদের দণ্ড কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত তাদের মুখে প্রকৃত হাসি ফুটবে না। আজ যে ঘটনার রায় হলো, এর পেছনে রয়েছে দেশের ইতিহাসে ‘জুলাই হত্যাকাণ্ড’ নামে বড় এক ট্র্যাজেডি। তবে এ রায় কিছুটা আশা জাগালেও পরিবারগুলো ন্যায়বিচারের পূর্ণতা দেখতে চায় দণ্ড কার্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে। মীর মুগ্ধর ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বলেন, শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডে আমরা খুশি হয়েছি। তবে অবিলম্বে তাকে দেশে এনে রায় কার্যকর করতে হবে।

মিরপুরে শহীদ শাহরিয়ার বিন মতিনের বাবা আব্দুল মতিন বলেন, রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। তবে যেদিন শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা হবে, সেদিন আমরা সত্যিই খুশি হতে পারব। শহীদ নাফিজের বাবা গোলাম রহমান লিটন বলেন, যেদিন হাসিনাকে দেশে এনে ফাঁসি কার্যকর করা হবে, সেদিনই সব শহীদপরিবার শান্তি পাবে। অন্যথায় এ রায় নিয়ে শহীদপরিবারগুলোর অসন্তোষ থেকেই যাবে।

যাত্রাবাড়ীতে শহীদ মিরাজের বাবা আব্দুর রব অশ্রুসিক্ত চোখে যুগান্তরকে বলেন, আমার ছেলেকে আর পাব না। কিন্তু খুনি হাসিনার ফাঁসি দেখে মরতে চাই। আজকের রায় আমার সন্তানের রক্তের ঋণ শোধের প্রথম ধাপ। শহীদ রাব্বীর বাবা শরীয়তপুরের মিরাজ মিয়া বলেন, হাসিনার রায় দ্রুত কার্যকর না করলে আমাকে ১০০ গুলি করুন। আমার ছেলে ছিল আমার প্রাণ। পুলিশ-র‌্যাবের গুলিতে তার মাথা উড়ে গেছে। তাই হাসিনাকে জনসম্মুখে একবার নয়-হাজারবার ফাঁসি দেওয়া উচিত।

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদী সাংবাদিকদের বলেছেন, ফাঁসির রায় শুধু দেশের জন্য নয়, পুরো বিশ্বের জন্য নজির স্থাপন করেছে। তিনি বলেন, পৃথিবীর কোনো ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। কোনো স্বৈরাচার সারা জীবন মানুষকে দমন করে বেঁচে থাকতে পারবে না। ফলে এ রায় শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, পুরো পৃথিবীর জন্য বড় নজির স্থাপন করেছে।

উত্তরায় আহত মুস্তাঈন বিল্লাহ বলেন, আমি ৯ মাস বুলেটের জখম নিয়ে হাসপাতালে কাতরিয়েছি। আমাদের এভাবে হতাহত করার কারণ ছিল হাসিনার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা। আজ আমরা চাই-তার ফাঁসি কার্যকরের মঞ্চেও সে কাঁদুক। একই ক্ষোভ প্রকাশ করেন আহত জুলাই যোদ্ধা সালমান হোসেনও। তিনি বলেন, তিন মাস হাসপাতালে ছিলাম। হাসিনা আর তার বাহিনী আমাদের রক্তে সাঁতার কেটে দেশ চালিয়েছে। তাকে ফিরিয়ে এনে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতেই হবে।

সরেজমিন দেখা যায়, বহুলপ্রতীক্ষার এ রায় দেখার আকাঙ্ক্ষায় সোমবার সকাল থেকেই ট্রাইব্যুনাল এলাকায় ভিড় করেন জুলাই আন্দোলনে আহত ও শহীদদের স্বজন, আন্দোলনকারী এবং সাধারণ মানুষ। কড়া নিরাপত্তার মাঝেও স্লোগানে স্লোগানে মুখর ছিল ট্রাইব্যুনালের আশপাশ এলাকা। দুপুরে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে উচ্ছ্বাস করেন তারা। কাউকে দেখা যায় মিষ্টি বিতরণ করতে। কেউ কেউ আবার মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করতে ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে সেজদাসহ মোনাজাত করেন। দুপুরের দিকে রায়ের খবর প্রকাশ হতেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন সাধারণ জনতা। এ সময় তাদের মুখে শোনা যায়-‘এ মুহূর্তে খবর এলো, শেখ হাসিনার ফাঁসি হলো’, ‘দড়ি লাগলে দড়ি নে, শেখ হাসিনার ফাঁসি দে’।

রায়ের খবর শুনে ‘মঞ্চ ২৪’ নামের ব্যানারে একদল ছাত্র-জনতা হাইকোর্টের সামনেই সেজদা দিয়ে ও মোনাজাত করে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। গণসেজদার পর মোনাজাতে ‘মঞ্চ ২৪’-এর আহ্বায়ক ফাহিম ফারুকী বলেন, ‘আরশের মালিক আল্লাহ, তোমার রহমতের ছায়ায় আমাদের বাংলাদেশকে তুমি রক্ষা করো। আল্লাহ যারা এখানে দাঁড়িয়ে আছেন, যারা গুম ছিল, যাদের জীবন থেকে যৌবনের সুন্দর সময়টুকু শেষ হয়ে গেছে; শেখ হাসিনা যাদের জীবন থেকে যে সময়টুকু কেড়ে নিয়েছে, তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে জনতার সামনে জাহান্নামের আজাব দিয়ে দিও। এই মাটিতে যেন সব হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়। পৃথিবীর কেউ যেন আমাদের এই রাষ্ট্রের এক ফোঁটা দখল নিতে না পারে।’

এই মঞ্চের ব্যানারে রায় পরবর্তী তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসিনুর রহমান বলেন, ‘আমাদের উচ্ছ্বাস বোঝাতে পারব না। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া, ন্যায়বিচার পেয়েছি। এই বিচার কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত আমার প্রশান্তি আসবে না, তারপরও আজ আমার মুখে হাসি। তবে এতটুকু বলতে চাই, এ বিপ্লবের একমাত্র মাস্টারমাইন্ড মহান আল্লাহ, তিনিই বিচার দিয়েছেন। আমরা সবাই শুকরিয়া আদায় করেছি আল্লাহপাককে সেজদা দিয়ে।’

প্রধান উপদেষ্টা আইনি সহায়তার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরাতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘তাকে আনার জন্য ভারতীয় জনগণের সহায়তা খুব প্রয়োজন। আমাদের বিশ্বাস, ইনশাল্লাহ তারা সেটি করবে। বিশ্বাস করতে চাই, পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকরাও সহায়তা করতে প্রস্তুত।

তবে তারা যদি সেটি না করে, ভারতের নাগরিকরা যদি খুনি হাসিনার পক্ষে অবস্থান নেয়, তাহলে বাংলাদেশের মানুষও বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখাবে।’

এর আগে সোমবার সকাল ১০টার পর থেকেই বিভিন্ন ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে হাজির হন আহত ও শহীদদের স্বজনরা। আবেগ, ক্ষোভ ও দীর্ঘদিনের যন্ত্রণা-সব মিলিয়ে স্থানটি পরিণত হয় এক গভীর প্রতীক্ষার প্রহরে। এ সময় তারা জুলাইয়ে গণহত্যায় জড়িতদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিতের দাবি জানান। বেলা ১১টার দিকে জাতীয় জাদুঘরের সামনে থেকে গণপদযাত্রা করে হাইকোর্টের মাজার গেটের ফটকের সামনে এসে অবস্থান নেয় জনজোট বিপ্লবী মঞ্চ নামে একটি সংগঠন। সংগঠনটির নেতাকর্মীদের ‘ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, খুনি হাসিনার ফাঁসি চাই’, ‘একটা একটা লীগ ধর, ধইরা ধইরা জেলে ভর’, ‘খুনি লীগের ঠিকানা, এই বাংলায় হবে না’ স্লোগান দিতে দেখা যায়। ওই সংগঠনের একজন বলেন, ‘আমরা চাই, শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হোক। একই সঙ্গে গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, সবার এই বাংলার জমিনে ফাঁসির রায় ঘোষণা হোক। অপরদিকে বাইরে রায়ের সংবাদ সংগ্রহের জন্য দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের বিপুলসংখ্যক গণমাধ্যমকর্মী উপস্থিত ছিলেন। ট্রাইব্যুনাল চত্বরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও সতর্ক অবস্থানে থাকতে দেখা যায়।

এদিকে এ রায়ে রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে আনন্দ-উল্লাস করে ছাত্র-জনতা। রায় ঘোষণার খবর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে এলাকায় শুরু হয় উল্লাস। আনন্দ মিছিল নিয়ে স্লোগান দেয় ছাত্র-জনতা। এ সময় ছাত্র-জনতা ‘লীগ ধর, জেলে ভর’, ‘এ মুহূর্তে খবর এলো, খুনি হাসিনার ফাঁসি হলো’ প্রভৃতি স্লোগান দিতে থাকেন। একই সঙ্গে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়ে উল্লাস করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা মিষ্টিও বিতরণ করেন।

এছাড়া রায়ের আগের দিন রোববার সন্ধ্যা থেকেই ট্রাইব্যুনাল এলাকায় নেওয়া হয় নজিরবিহীন নিরাপত্তাব্যবস্থা। সেনাবাহিনী ছাড়াও পুলিশ, র‌্যাব, এপিবিএন, বিজিবির অবস্থান ছিল পুরো এলাকায়। গোয়েন্দা সংস্থা সদস্যদের তৎপরতাও ছিল চোখে পড়ার মতো। দোয়েল চত্বর হয়ে শিক্ষা ভবনমুখী সড়কে যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়। সীমিত করা হয়েছে সাধারণ মানুষের চলাচলও।

জিবি নিউজ24ডেস্ক//

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন