মায়া কান্না নাকি কৌশল? দোভালের ভাষণ, হাসিনার উৎসাহ-প্ররোচনা এবং বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া

gbn

সহিদুল আলম স্বপন ||  সুইজারল্যান্ড  ||

ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল যখন প্রতিবেশী দেশগুলোর সাম্প্রতিক শাসন পরিবর্তনকে “দুর্বল ও অদক্ষ শাসনের ফল” বলে চিহ্নিত করেছেন, সেটি শুধু এক ধাঁচের অনুধাবন নয় তাতে লুকিয়ে আছে কৌশলগত বার্তা এবং ভৌগলিক নিরাপত্তা-চিন্তার উপমিশ। একই সময়ে, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন আওয়ামী লীগের সমর্থকদের আগামী ফেব্রুয়ারি-র নির্বাচনে বর্জনের আহ্বান জানান, তা দেশের ভেতরেই রাজনৈতিক উত্তেজনার মাত্রা বাড়িয়েছে এবং প্রতিবেশী শক্তির নজরকাড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দুই ভাবেই প্রকাশিত সংকেতগুলোকে কেবল ব্যক্তিগত মত নয়, বরং একটি বৃহত্তর কূটনৈতিক, নিরাপত্তা ও স্বার্থসংক্রান্ত খেলাধুলার অংশ হিসেবে দেখা উচিত। দোভালের ভাষ্য যেখানে “শাসন ব্যর্থতার” কথা বলছে, সেখানে আমাদের প্রশ্ন হওয়া উচিত  এর আড়ালে কি শুধু সতর্কতা, নাকি শক্তির প্রয়োগের সূচনা? এবং বাংলাদেশের জন্য উত্তরের পথ কি হওয়া উচিত? আবার এদিকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিজের বিবৃতিতে শব্দ ব্যবহারে সংযত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং।

প্রথমে মৌলিক সত্যটি স্বীকার করতে হবে: পরিবেশ বদলেছে এবং তা আমাদের এড়াতে পারবে না। ২০২৪-২০২৫ সালের ঘটনা-প্রবাহ রাজনৈতিক উথান , জাতীয় নেতৃত্বের উৎসমাপন, ক্ষমতার বিন্যাস সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক মানচিত্রে উল্লেখযোগ্য ভিন্নতা এনেছে। বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং ক্ষমতাচ্যুত নেতৃত্বের অবস্থান-প্রবৃত্তি কেবল অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়; তা অঞ্চলের স্থিতিশীলতার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। শেখ হাসিনার বিদেশে অবস্থান ও তাঁর বর্জনের আহ্বান, এবং এ নিয়ে গৃহীত নীতিমালা-বিধি আন্তর্জাতিক মনোযোগ ও অনিশ্চয়তা বাড়িয়েছে  এটি কেবল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বৈঠক বরাবরই নয়, প্রতিবেশী শক্তিগুলোর কৌশলগত চিন্তাতেও বড় পরিবর্তন নিয়ে এসেছে।  

অজিত দোভালের বক্তব্যকে যদি কেবল নিরাপত্তা-বিশ্লেষকের চিত্তবিনোদন হিসেবে দেখা হয়, সেটি অপ্রতুল হবে। দোভাল ন্যায়সঙ্গতভাবে যতবারই “সুশাসন” ও “কার্যকর প্রশাসনের ওপর জোর দিয়েছেন, ততবারই সেই বক্তব্য কৌশলগত উদ্দেশ্যের সাথে যুক্ত হয়ে ওঠে যখন তিনি প্রতিবেশী দেশগুলোর উদাহরণ টেনেছেন। এই কথা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে, শক্তি-রাজনীতিতে ‘নৈতিক’ ভাষ্য প্রায়ই কাজে লাগানো হয়ে থাকে: সুশাসনের দাবি দিয়ে আন্তঃরাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের ন্যায্যতা বা প্রভাব বিস্তারের দরজা সামান্য খুলে দেয়া যায়। দোভালের বক্তব্যে এই সম্ভাব্যতা অস্বীকার করা যেতেই পারে না; কারণ “শাসন দুর্বল” বলা মানে শুধু অনুশাসনের অভাব নয়  সেটি আক্রান্ত নীতিগত অবস্থান গঠন এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন আকর্ষণের এক উপায়ও হতে পারে।  

তবে স্মরণ রাখতে হবে, প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা স্বতন্ত্র এবং জটিল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বহুবিধ রেশ রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতির ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, সাংবিধানিক লড়াই, ধর্ম-রাজনীতি প্রভৃতির ছাপ আছে। যে কারণে বাইরে থেকে “দুর্বল শাসন” বলে এক লাইনে সবকিছু বিন্যাস করা সহজ কিন্তু অসত্য হতে পারে। অস্থিরতা থাকলে সেটিকে তৎক্ষণাৎ বহিরাগত হস্তক্ষেপ বা নির্দেশের মাধ্যমে সমাধান করা যায় না; বরং দীর্ঘমেয়াদি প্রতিষ্ঠান গঠন, মানবাধিকার রক্ষা, বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা এবং অর্থনৈতিক ন্যায্যতা নিশ্চিত করাই স্থিতিশীলতার প্রকৃত মূল। এখানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, বিচারব্যবস্থা ও সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা হবে নির্ধারক।

আরেকটি বাস্তবতা: ভারতের দৃষ্টি পরিবর্তন এবং বাংলাদেশের কৌশলগত পুনর্নির্দেশনা বাস্তবে ঘটছে। গত কয়েক মাসে  রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং নতুন মধ্যস্থ সরকার কূটনীতিতে ভিন্ন ধারা সৃষ্টি করেছে; ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক যেন একদিনে আগের মত আর নেই। সম্পর্কের এই ঝরনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ক্রমে বহুদলীয় বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করার দিকে অগ্রসর হচ্ছে, যার মধ্যে চীনকে স্থান দেওয়ার কথা উল্লেখযোগ্যভাবে সামনে এসেছে। এ পরিবর্তন ভারতীয় কূটনীতির উদ্বেগ বাড়িয়েছে এবং সে কারণে প্রতিটি রাজনৈতিক বাগে-বাগে অভিযোজন ও সমন্বয় দাবি করছে। এই বাস্তবতায় দোভালের কণ্ঠে যে সতর্কতা তাতে কূটনৈতিক অর্থ রয়েছে তবে সেটি কেবল নীতিগত নয়, কৌশলগত প্রতিক্রিয়ারও ইঙ্গিত বহন করে।  

এখানে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্ন হলো: আমরা কীভাবে নিজেদের আত্মনির্ভরতা, সার্বভৌম সত্তা এবং স্থিতিশীলতা রক্ষা করব যাতে কোন বহিরাগত শক্তি ‘ভাল শাসন’ বা ‘দুর্বল শাসন’ কথা বলে আমাদের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ায় অনুপ্রবেশের সুযোগ লাভ না করে? প্রথমত, স্বচ্ছতা ও সংলাপ বৃদ্ধির প্রয়োজন। যেখানে জনগণের আস্থা কমে, সেখানে সরকার বা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে জনগণের সঙ্গে খোলামেলা যোগাযোগ বাড়াতে হবে। জাতীয় সংলাপে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী শ্রেণী ও প্রগতিশীল ধর্মীয় সংগঠনকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি গ্রহণযোগ্য রূপরেখা তৈরির কাজ জরুরি। যদি নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে সঙ্কোচ থাকে, তাতে সংলাপই বিকল্প।

দ্বিতীয়ত, আইনি ও সাংবিধানিক ব্যবস্থা শক্ত করা। বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা রক্ষা না করলে আন্তর্জাতিকভাবে “দুর্বল শাসন” কথাটি সহজে প্রচলিত হবে এবং তা কৌশলগতভাবে ব্যবহৃত হবে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে আমাদের বক্তব্য প্রমাণযোগ্য করতে হবে স্বতন্ত্র রিপোর্ট, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারে। তদুপরি, মানবাধিকার ও প্রেস-স্বাধীনতার স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক আস্থাকে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে।

তৃতীয়ত, কৌশলগত বহুমুখিতা বজায় রাখা। একটি শক্ত কূটনৈতিক নীতি যেটি কখনও একপক্ষীয় নির্ভরতার দিকে নিয়ে যায়, সেটি ভবিষ্যতে আমাদের জন্য জটিলতা তৈরি করতে পারে। ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব অমূল্য, তবু সেই বন্ধুত্বকে কেবলমাত্র একভাবে নির্ধারণ করে বসে থাকা জায়েজ নয়। অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা ও পরিকাঠামোগত অংশীদারিত্ব বহুমুখী রাখা বাংলাদেশকে ঠাসা কৌশলগত চাপ থেকে রক্ষা করবে। রাজনৈতিক সংকটের সময় এ বহুমুখিতা বিশেষভাবে কাজে লাগবে কারণ একটি দেশের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা থাকলে তা প্রতিপক্ষের কৌশলগত রূপে রূপ নেয়।  

চতুর্থত, জনগণের কণ্ঠস্বরকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। শেখ হাসিনার আহ্বান যদি বৃহৎ অংশকে অনুপ্রাণিত করে এবং সেটি গণতান্ত্রিকভাবে স্বীকৃত হয়, তাহলে সেটাকে উপেক্ষা করা দেশের স্বার্থে নয়। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করা ছাড়া দেশের অভ্যন্তরীন ফাটল আরও গাঢ় হবে এবং সেটাই বহিরাগত কৌশলগুলোর অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। বৈধতা ছাড়া কোনো ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হয় না  তাই নির্বাচন যদি বিতর্কিত হয়, তার শাস্তি ইতিবাচক নীতিগত পরিবর্তনে নয়, বরং দেশের আস্থা ও আন্তর্জাতিক অবস্থার জন্য ক্ষতিকর হবে।  

পরিশেষে , দোভালের মন্তব্যকে কেবল অপব্যাখ্যা করলে আমরা অন্ধকারে হাঁটব। এটি একটি সতর্কবার্তা; আবার এটি কৌশলগত পদক্ষেপের নামে ব্যবহৃতও হতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এখন প্রয়োজন দারুণ ধৈর্য, কূটনৈতিক চাঞ্চল্য এবং অভ্যন্তরীণ সমাধানের পক্ষপাতিত্ব। আমাদের উচিত শক্ত অবস্থান গ্রহণ করা: জাতীয় স্বার্থ রক্ষা, বিভাজনহীন সংলাপ প্রতিষ্ঠা, বিচার ও মানবাধিকার নিশ্চিতকরণ এবং বহুমুখী কূটনীতি বজায় রাখা। এতে আমরা কেবল ‘মায়ার কান্না’ নয় আমাদের স্বকীয় শক্তি ও গণতান্ত্রিক মর্যাদা রক্ষা করব।

এই সময়ে যে কোনও একতরফা আভ্যন্তরীণ পদক্ষেপ বা বহিরাগত বার্তাকে সহজভাবে গ্রহণ করলে দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদের কূটনীতি হবে যদি তৃতীয় পক্ষের নীতি নয়, দেশের জনগণের দাবি এবং সংবিধানের প্রতি আনুগত্যের ওপর ভিত্তি করে গঠিত হয়। দোভাল বা যে কোনো প্রতিবেশী কণ্ঠকে বিচার করার একমাত্র মানদণ্ড হওয়া উচিত বাংলাদেশের সার্বভৌম স্বার্থ, মানুষের নিরাপত্তা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার। যদি সেই ভিত্তি ধরে আমরা চলি, তাহলেই ‘মায়ার কান্না’ কেবল শব্দেই সীমাবদ্ধ থাকবে  আর বাস্তবে আমরা একটি পরিণত, স্থিতিশীল এবং সম্মানজনক রাষ্ট্র হিসেবেই সামনে এগিয়ে যাব।  

সহিদুল আলম স্বপন,  সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বেসরকারি ব্যাংকিং আর্থিক অপরাধ বিশেষজ্ঞ, কলামিস্ট ও কবি

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন