আন্তর্জাতিক আইনের ধারাবাহিক লঙ্ঘনের দায়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ’ ঘোষণার লক্ষ্যে আগামী সপ্তাহে কলম্বিয়ার বোগোটায় জরুরি সম্মেলনে বসছে ২০টিরও বেশি দেশ। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আইকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্ট কূটনীতিকরা।
মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) ও বুধবার (১৬ জুলাই) অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই সম্মেলন আয়োজন করছে কলম্বিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার, যারা বর্তমানে ‘দ্য হেগ গ্রুপের’ সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। আন্তর্জাতিক আইন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইসরায়েল এবং তার প্রভাবশালী মিত্রদের ‘দায়মুক্তির সংস্কৃতি’র বিরুদ্ধে সমন্বিত কূটনৈতিক ও আইনগত পদক্ষেপ নিতে এই গ্রুপ গঠিত হয়েছে।
দ্য হেগ গ্রুপের সূচনা হয় ২০২৪ সালের ৩১ জানুয়ারি, নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে। তখন আটটি দেশ- বলিভিয়া, কলম্বিয়া, কিউবা, হন্ডুরাস, মালয়েশিয়া, নামিবিয়া, সেনেগাল ও দক্ষিণ আফ্রিকা- গ্রুপটির প্রাথমিক সদস্য হিসেবে এতে যোগ দেয়।
দক্ষিণ আফ্রিকার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সহযোগিতা বিষয়ক মন্ত্রী রোল্যান্ড লামোলা মিডল ইস্ট আইকে বলেন, দ্য হেগ গ্রুপ গঠনের মাধ্যমে বিশ্বে ‘ব্যতিক্রমবাদ’র বিরুদ্ধে ও আন্তর্জাতিক আইনের অবমূল্যায়নের প্রতিক্রিয়ায় একটি মোড় ঘুরে গেছে। বোগোটা সম্মেলন সেই চেতনারই প্রকাশ। এখানে উপস্থিত রাষ্ট্রগুলো একটি পরিষ্কার বার্তা দেবে যে, কোনো জাতি আইনের ঊর্ধ্বে নয় এবং কোনো অপরাধ দায়মুক্ত থাকতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, আমরা সবাই মিলে আইনগত, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবো, যা ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের ধ্বংসযজ্ঞ থামাতে তাৎক্ষণিক ভূমিকা রাখতে পারে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে এখন পর্যন্ত ৫৭ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন ও পুরো উপত্যকার প্রায় সমগ্র জনগোষ্ঠী বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তাছাড়া ২০ লাখেরও বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন। এই আগ্রাসনকে ক্রমেই ‘গণহত্যা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ও একাধিক দেশের সরকার।
কলম্বিয়ার বহুপাক্ষিক বিষয়ক উপমন্ত্রী মাউরিসিও জারামিলো জাসির বলেন, এই গণহত্যা আমাদের সমগ্র বহুপাক্ষিক ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। কলম্বিয়া কখনোই বর্ণবাদ ও জাতিগত নিধনের সামনে নীরব থাকতে পারে না। তিনি আরও বলেন, বোগোটায় আমরা শুধু প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করব না, বরং সরাসরি পদক্ষেপের জন্য একগুচ্ছ নির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করব।
অংশগ্রহণকারী দেশ ও কর্মকর্তারা
আলজেরিয়া, বাংলাদেশ, বলিভিয়া, ব্রাজিল, চিলি, চীন, কিউবা, জিবুতি, হন্ডুরাস, ইন্দোনেশিয়া, আয়ারল্যান্ড, লেবানন, মালয়েশিয়া, নামিবিয়া, নিকারাগুয়া, ওমান, পর্তুগাল, স্পেন, কাতার, তুরস্ক, সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড দ্য গ্রেনাডিনস, উরুগুয়ে ও ফিলিস্তিন।
সম্মেলনে জাতিসংঘের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা উপস্থিত থাকবেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন- ফিলিস্তিনবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি ফ্রানচেসকা আলবানিজ, ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক জাতিসংঘ সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর প্রধান ফিলিপ লাজারিনি, স্বাস্থ্য অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি ত্লালেং মোফোকেং, নারীর প্রতি বৈষম্যবিরোধী জাতিসংঘ ওয়ার্কিং গ্রুপের চেয়ার লরা নিয়িরিনকিন্ডি, ভাড়াটে সেনা বা সশস্ত্র গোষ্ঠীসংক্রান্ত জাতিসংঘের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ আন্দ্রেস ম্যাসিয়াস তোলোসা।
এখন পর্যন্ত যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে দ্য হেগ গ্রুপ
দ্য হেগ গ্রুপের সদস্য দেশগুলো গত ২০ মাসে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ আইনগত ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-
দক্ষিণ আফ্রিকা গাজার গণহত্যার অভিযোগে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মামলা দায়ের করেছে। পরে বলিভিয়া, কলম্বিয়া ও নামিবিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশ এই মামলায় যুক্ত হয়।
নামিবিয়া ও মালয়েশিয়া ইসরায়েলের উদ্দেশ্যে অস্ত্রবাহী জাহাজকে তাদের বন্দরে ঢুকতে দেয়নি। কলম্বিয়া ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত জোটের প্রতিটি দেশ নিজেদের মতো করে পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে দ্য হেগ গ্রুপের সদস্য ও সমর্থক দেশগুলো এখন থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
গ্রুপের সমন্বয়ক ভার্শা গান্দিকোটা-নেলুটলা বলেন, আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যতামূলক সিদ্ধান্ত মানতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের ব্যর্থতার প্রতিক্রিয়ার অংশ হিসেবেই গঠিত হয়েছে এ গ্রুপ। গান্দিকোটা-নেলুটলা তার বক্তব্যে পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের দিকে ইঙ্গিত করেছেন।
২০২৪ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও দেশটির সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু পশ্চিমা দেশ এ পরোয়ানার সমালোচনা করেছে।
তাছাড়া ইসরায়েল আইসিজের একাধিক নির্দেশ অমান্য করেছে। দেশটির প্রতি আইসিজে যেসব নির্দেশ দিয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- গাজায় গণহত্যা সনদের লঙ্ঘন ঠেকাতে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া।
জিবি নিউজ24ডেস্ক//

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন