মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা ভুইয়া।।
কারবালার ঘটনা সমগ্র বিশ্ব মুসলিমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারবালার প্রান্তরে উম্মতের কান্ডারী, দয়াল নবী রাসুল (সা.)-এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)=এর মর্মান্তিক শাহাদতবরণ বিশ্ব ইতিহাসে এক মর্মান্তিক কালো অধ্যায়। ৬১ হিজরির এ মর্মান্তিক শাহাদতবরণ দুনিয়ার আশেকে রাসুল (সা.) ও উম্মতে মোহাম্মদী (সা.) এর হৃদয়কে আজও ভারাক্রান্ত করে।
হিজরি ৬১ সালের ১০ই মহররম কারবালার ময়দানে ভয়াবহ হৃদয়বিদারক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটেছিলো। কারবালার মরুপ্রান্তরে মাওলা ইমাম হুসাইন (আ.) ও তার ৭২ জন সাথী যে বীরত্বের ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন, তা ইতিহাসের একটি কালজয়ি অধ্যায় হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। কারবালা নির্দিষ্ট ক্ষণে শুধুমাত্র একটি যুদ্ধ ছিলো না। ঐ বীরত্বগাঁথার ব্যাপ্তি এতটাই বিস্তৃত ছিলো যে, তা স্থান ও কালকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। যে সব কারণে ইমাম হুসাইন (আ.) এর আন্দোলন এত বিশাল প্রভাব বিস্তার করেছে তার মধ্যে এর মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং এর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ অন্যতম। বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.) এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (আ.) অত্যাচারী, চরিত্রহীন, ক্ষমতালোভি শাসক এজিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, "আমি সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎ কাজে বাধা প্রদানের উদ্দেশ্যে সংগ্রামে নেমেছি"।
কারবালা্র ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বলা যায়, ইমাম হুসাইন (আ.) নৈতিক ও মানবীয় মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। কারবালার ময়দানে ইমাম হুসাইন বিন আলী (আ.) এর সাথে যেসব মহান শহীদ আত্মত্যাগ করেছিলেন, তাদের সবার প্রতিটি পদক্ষেপে এসব মূল্যবোধ অক্ষুন্ন রাখার প্রচেষ্টা ছিলো লক্ষ্যণীয়। নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি সাহসিকতা ও বীরত্ব ছিলো কারবালা আন্দোলনের প্রধান আকর্ষণ।
কারবালার শহীদ হয়েছিলেন যারা : কারবালায় হযরত আবা আবদুল্লাহ আল-হুসাইন (আ.)-এর বিপ্লবে যারা সহযোগিতা করেছেন, তাদেরকে ইতিহাসে সাতটি দলে চিহ্নিত করেছে। প্রথম দল হল সেই সকল শহীদ যারা ইমাম হুসাইন (আ.) কারবালায় আসার পূর্বে শহীদ হয়েছিলেন। আর এই দলের নেতা সুলাইমান বিন রাজিন। তিনি বসরায় শহীদ হয়েছিলেন। তিনি ইমামের বার্তা বাহক ছিলেন এবং তিনি হযরত আবা আবদুল্লাহর পক্ষে ছিলেন বলে জানার পর উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ তাকে গ্রেফতার করে শহীদ করে এবং তারপর কুফার দিকে চলে যায়। মুসলিম বিন আকিল, কায়স বিন মাসহার এবং আবদুল্লাহ বিন ইয়াকতারের মতো ব্যক্তিরাও এই দলের অন্তর্ভুক্ত, যারা ইমাম হুসাইনের (আ.) আন্দোলন এবং কারবালায় তার আগমনের আগে শহীদ হয়েছিলেন। এই দলের অন্যতম নেতা কুফার মেইসামে তাম্মার।
দ্বিতীয় দল হলেন যারা আশুরার সকালে তীরের বৃষ্টিতে শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছিলেন। আশুরার সকাল শুরু হয়েছিল তীর নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে এবং উমর সাদই সর্বপ্রথম তীর নিক্ষেপ করা শুরু করেছিল এবং তীর নিক্ষেপের ফলে ইমাম হুসাইনের (আ.) ৫২জন সঙ্গী শাহাদের পেয়ালা পান করেছিলেন।
কারবালায় যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর রাসূল (সা.) এর সাহাবী ছিলেন এবং নবী করিম (সা.)-এর সময়ে সংঘটিত যুদ্ধে তারা অংশগ্রহণ করেছেন। শৈশবে ইমাম হুসাইন (আ.)-কে নবীর (সা.) সাথে দেখেছেন এবং তাঁর সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট হতে অনেক হাদিস শুনেছেন। তাদের মধ্যে ছিলেন কারবালার শহীদ হাবিব বিন মাযাহের (রা.) এবং মুসলিম বিন আউসজা (রা.)।
শহীদদের তৃতীয় দল হল যারা আশুরার দিনে কারবালার ময়দানে এক এক করে অথবা কয়েক জন মিলে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। যেমন, যারা বসরা থেকে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর খেদমতে এসেছেন, তারা দলবদ্ধ হয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। মাঝে মধ্যে শত্রুপক্ষ তাদেরকে ঘিরে ফেলতো এবং হযরত আব্বাস (আ.) ময়দানে যেয়ে অবরোধ ভেঙ্গে তাদেরকে ফিরিয়ে আনতেন। পুনরায় তারা ময়দানে ফিরে যেতেন এবং আহত হতেন ও শাহাদাত বরণ করতেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন আব্দুল বিন উমাইর কালবী (রা.)। একা একা সরাসরি যুদ্ধে সর্বশেষে যে শাহাদাত বরণ করেন তিনি হলেন হাবিব বিন মাজাহের আসাদী (রা.)। তিনি ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বাম শাখার কমান্ডার ছিলেন।
শহীদদের পরবর্তী দল হচ্ছেন কারবালার শহীদদের চতুর্থ দল। এই দলের শহীদগণ আশুরার দিনে জোহরের নামাজের সময় শাহাদাত বরণ করেন। ইমাম হুসাইন (আ.) জোহরের আযানের সময় শান্তিপূর্ণভাবে নামাজ আদায়ের জন্য এবং যুদ্ধ বিরতির জন্য হযরত আবুল ফজল আব্বাস (আ.)-কে শত্রুদের কাছে পাঠিয়েছিলেন। যুদ্ধের ময়দানে সালাতুল খাউফ আদায় করা হয়। আর এজন্য ইমাম হুসাইন (আ.) দুই রাকাত খাউফের নামাজ আদায় করেন। এই দুই রাকাত নামাজ আদায় করার সময় ইমামের দলের দুই জন সেনা শহীদ হন।
শহীদদের পরবর্তী দল হচ্ছেন যারা নামাজের পর শহীদ হয়েছেন। ইমামের এসকল সাথীগণ এক এক করে রণক্ষেত্রে গিয়েছেন এবং শাহাদাত বরণ করেছেন। আশুরার দিনে জোহরের নামাযের পর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শহীদদের একজন হলেন জুহাইর বিন কাইন (রা.), যিনি একজন মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি হযরত আবা আবদুল্লাহ আল হুসাইন (আ.)এর সৈন্যবাহিনীর ডান শাখার দায়িত্বে ছিলেন এবং পথে তাঁর সাথে যোগ দেন।
এই কয়েকজন লোক শহীদ হওয়ার পর, বনি হাশিমের পালা, অর্থাৎ হযরত আবা আবদুল্লাহ আল-হুসাইনের পরিবার, যেমন আকিলের সন্তান, ইমাম হাসান মুজতবা (আ.)-এর সন্তান, আমিরুল মু’মিনিনেরর (আ.) সন্তান; অর্থাৎ ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ভাইয়েরা আবুল ফজল আল-আব্বাস, জাফর, উসমান এবং আবদুল্লাহ। এর পর ইমাম হুসাইন (আ.) শহীদ হন এবং কারবালার ঘটনার পর এই মহা ট্রাজেডিকে কেন্দ্র করে অনেকে শহীদ হন।
সর্বশেষ যে ব্যক্তি কারবালায় উপস্থিত ছিলেন এবং শহীদ হয়েছেন, তিনি বসরা থেকে কারবালায় পৌঁছেছিলেন। কিন্তু তিনি দেরিতে পৌঁছেছিলেন এবং তিনি যখন পৌঁছেছিলেন তখন শত্রুপক্ষের সৈন্যরা আনন্দ ও উল্লাস করছিল। তিনি বুঝতে পারেন যে হযরত আবা আবদুল্লাহ শহীদ হয়েছেন, তাই তিনি তরবারি নিয়ে কারবালা চত্বরে যুদ্ধ করেন এবং শহীদ হন। তার নাম হাফহাফ বিন মোহান্দ রাসবি বসরী। আর এই শহীদকে কারবালার শেষ শহীদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
কারবালায় শহীদগণের তালিকা আহলে বাইত ও হাশেমী বংশের সদস্যগণ: ১ । ইমাম আলী মোকাম হযরত ইমাম হোসাইন (আ.), ২। হযরত আব্বাস ইবনে আলী (আ.) কারবালার সেনাপতি, ৩। হযরত জাফর ইবনে আলী (আ.), ৪ । হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আলী (আ.), ৫। হযরত আবু ওসমান ইবনে আলী (আ.), ৬। হযরত আবুবকর ইবনে আলী (আ.), ৭। হযরত মুহাম্মদ ইবনে আলী (আ.), ৮। হযরত কাসেম ইবনে ইমাম হাসান (আ.), ৯ । হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ইমাম হাসান (আ.), ১০। হযরত আবু বকর ইবনে ইমাম হাসান (আ.), ১১। হযরত আলী আকবর ইবনে ইমাম হোসাইন (আ.), ১২। হযরত আলী আসগর ইবনে ইমাম হোসাইন (আ.), ১৩। হযরত জাফর ইবনে আকিল (আ.) ইমাম হোসাইনের (আ.) চাচাতো ভাই, ১৪ । হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুসলিম (আ.), ১৫। হযরত আওন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে জাফর (আ.) হযরত জয়নব ( আ.) এর পুত্র, ১৬। হযরত মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে জাফর (আ.) হযরত জয়নব (আ.) পুত্র, ১৭। হযরত আবদুল রহমান ইবনে আকীল (আ.), ১৯। হযরত আলী ইবনে আব্বাস (আ.), ১৮। হযরত মুহাম্মদ ইবনে আবি সাঈদ , বনে আকীল (আ.)। # রাসুলাল্লাহ (আ) এঁর সাহাবাগণ : ২০। হযরত হাবীব ইবনে মুজাহের (রা.), ২১। হযরত মুসলিম ইবনে আউসাজা আল আসাদী (রা.), ২২। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমের আল্ কালবী (রা.), ২৩। হযরত আনাস ইবনে হারেস (রা.), ২৪। হযরত বারির ইবনে হোযাইর হামাদানী (রা.), ২৫। হযরত জুহাইর ইবনে কাইন বাজালী (রা.), ২৬। হযরত হাজ্জাজ ইবনে মাসরুক আল জু'ফী (রা.), # ইমাম হোসাইন (আ)-এঁর সঙ্গী সাথীগণ : ২৭। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমাইর আল কালবী (রা.), ২৮। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আযরা আল গেফারী (রা.), ২৯। হযরত আবদুর রহমান ইবনে আযরা আল গেফারী (রা.), ৩০। হযরত নাফে ইবনে হেলাল আল জামালী (রা.), ৩১। হযরত জাবের ইবনে হাজ্জাজ আত তামীমী (রা.).
৩২। হযরত জাবেলা ইবনে আলী আশ্ শায়বানী (রা.), ৩৩। হযরত জুনাদা ইবনে হারেস ইবনে সুলায়মান (রা.), ৩৪ । হযরত জুনাদা ইবনে কা'ব আনসারী (রা.), ৩৫। হযরত হানযালা ইবনে আসয়াদ আশ শাবামী (রা.), ৩৬। হযরত হাবাশ ইবনে কাইস নাহসী (রা.), ৩৭। হযরত যাইন ইবনে মালেক আত তাইমী (রা.), ৩৮। হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবদে রাব্বীহ আল্ আনসারী (রা.), ৩৯। হযরত ওমর ইবনে জুনাইদা (রা.), ৪০। হযরত আমর ইবনে কারজাতাল আনসারী (রা.), ৪১। হযরত ওহাব ইবনে আবদুল্লাহ আল কালবী (রা.), ৪২। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে বাসার খেলমী (রা.), ৪৩। হযরত ওয়াকিয়াহ ইবনে সাঈদ ইবনে আল হাতেম আতায়ী (রা.), ৪৪। হযরত আসমার ইবনে হেশাম ইবনে আল হাতেম আততায়ী (রা.), ৪৫ । হযরত মুসলিম ইবনে কুজাইর ইবনে আল হাতেম আত্তায়ী (রা.), ৪৬। হযরত আসলাম আত তুরকী (রা.), ৪৭। হযরত সাইফ ইবনে হারেস ইবনে সুরাই (রা.), ৪৮। হযরত হারেস ইবনে সুরাই (রা.), ৪৯। হযরত কাসেম ইবনে হাবীব (রা.), ৫০ । হযরত মাসউদ ইবনে হাজ্জাজ আত্তাইমী (রা.), ৫১। হযরত যিয়াদ ইবনে গরিয আল সায়দাবী (রা.), ৫২। হযরত জাহের ইবনে আমর আল কিন্দী (রা.), ৫৩। হযরত সাঈদ ইবনে আবদুল্লাহ আল্ হানাফী (রা.), ৫৪ । হযরত সালমান ইবনে নাজ্জার আল্ বাজালী (রা.), ৫৫। হযরত সুয়ায়েদ ইবনে আমর ইবনে আবিল মুতা (রা.), ৫৬। হযরত সাইফ ইবনে মালেক আবদী (রা.), ৫৭। হযরত জারসাগা ইবনে মালেক তাবলাগী (রা.), ৫৮ । হযরত শোওয়াব ইবনে আবদুল্লাহ আশ্ শাকেরী (রা.), ৫৯ । হযরত ইয়াহিয়া ইবনে সালেম আদী (রা.), ৬০। হযরত আবেস ইবনে আবি শাবীব শাকেরী (রা.), ৬১ । হযরত ওমর ইবনে আবদুল্লাহ জুন্দী (রা.), ৬২। হযরত মওকা ইবনে সামানা (রা.), ৬৩। হযরত নোমান ইবনে আমর আররাসি (রা.), ৬৪ । হযরত আয়েদ ইবনে যিয়াদ কাবাদী (রা.), ৬৫। হযরত আয়েদ ইবনে মিগভিল খাওকী (রা.), ৬৬। হযরত হুর ইবনে ইয়াজিদ আর রিয়াহী (রা.), ৬৭। হযরত মাআছ ইবনে ইয়াজিদ আর রিয়াহী (রা.), ৬৮ । হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ইয়াজিদ আর রিয়াহী (রা.), ৬৯। হযরত আবদুল আলা ইবনে ইয়াজিদ আর রিয়াহী (রা.), ৭০ । হযরত মুনজেহ (রা.) {ইমাম হুসাইন (আ.) খাদেম), ৭১। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে বুকতুর (রা.), ৭২। হযরত আবু যব (রা.) ( ইমাম হুসাইন (আ.) গোলাম)। এছাড়াও কুফায় ইমামের (আ.) পত্র নিয়ে আসা দূত হযরত কায়েস ইবনে মুসাহ্হার (রা.)-এবং ইমামের (আ.) চাচাতো ভাই হযরত মুসলিম বিন আকিল (রা) কুফায় ইবনে যিয়াদ কর্তৃক শাহাদাত বরণ করেন। ( সূত্র: তারিখে তাবারী, নেহায়াতুল আরব, বেদায়া ওয়ান নেহায়া, আঞ্জুমানে সিরাজাম মুনিরা)।
কারবালার ময়দানে ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীগণ ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিলেন, যার উদাহর পৃথিবীতে বিরল। কারবালায় শাহাদাতের কয়েকদিন আগে থেকে তিনি বিভিন্নভাবে সাথীদের ধৈর্যধারণের বিষয়টি শিক্ষা দিয়ে আসছিলেন। পাপাত্মা এজিদের বাহিনী কারবালায় যে নারকীয় হত্যাযঙ্গে মেতে উঠেছিলো তা দেখে সহ্য করা কোন মানুষের পক্ষেই হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু আল্লাহর ওপর নির্ভরতা ও তার প্রতিশ্রুত পুরস্কার প্রাপ্তির আশায় ইমামের সাথীগণ এ ব্যাপারে ছিলেন নির্বিকার ও দৃঢ়চিত্ত। শত্রুবাহিনী যখন ইমামের দুধের শিশু থেকে শুরু করে তরুণ ও যুবক সন্তানদের এবং তার প্রাণপ্রিয় ভাইকে হত্যা করে চলছিলো, তখন আশুরার মহান বিপ্লব সফল করার জন্য ইমামের আকাঙ্খা ও শপথ আরো কঠিন হচ্ছিলো। প্রিয় নবীজির বংশধরদের শাহাদাৎ তাকে বিন্দুমাত্র তাঁর অবস্থান থেকে টলাতে পারে নি।
কারবালায় মাওলা ইমাম হুসাইন (আ.) এর দেহ পদদলিত করেছিলো : ইতিহাস পর্যালোচনা করলে পাওয়া যায়, নিষ্ঠুর ইয়াজিদ যে ঘোড়াগুলো ইমাম হুসাইন (আ.) এর দেহ পদদলিত করিয়েছিলো সেগুলো অন্য ঘোড়াগুলো থেকে আলাদা ছিলো। যা “আওয়াজ্জিয়া” নামে পরিচিত। এক গবেষক মাস পর মাস এটা নিয়ে গবেষণা করেছে। এর মধ্যে সে একটি জার্মানি বইয়ে পেয়েছে যার নাম World Strongest Stallion or In Stallions (মদ্দা ঘোড়া) এই ঘোড়াগুলো কোন কিছু বাটা বা পদদলিত করার কাজে ব্যবহার করা হয়। যার শুধু পায়ের ওজনই ৬৫ কেজির বেশি হয়ে থাকে।
যখন ইবনে যিয়াদের এক সৈন্য থেকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে, তুমি কারবালায় সবচাইতে বেশি এমন কোন অত্যাচারটি দেখেছ যা কখনোই দেখনি? সে বলেছে আমি ইমাম হুসাইন (আ.) এর পাঁজরের হাড় ভাঙার শব্দ শুনেছি। যখন আমরা ইমাম হুসাইন (আ.) এর দেহ’র উপর দিয়ে আমাদের ঘোড়া দৌড়াতাম তখন উনার পাঁজরের হাড় ভাঙার শব্দ সারা কারবালায় গর্জে উঠত।
অনেকেই প্রশ্ন করেন যে আমরা ইমাম হুসাইন (আঃ) এর উপর এত কান্না করি কেন? তারা একটু চিন্তা করে দেখুক না কেন, ইতিহাসে পাওয়া যায় ইমাম হুসাইন (আঃ) কে ১০টি ঘোড়া দ্বারা পদদলিত করা হয়েছিলো যার একটি পায়ের ওজন ছিলো ৬৫ কেজি একটি ঘোড়ার ৪টি পা ১০টি ঘোড়া। ৪x১০=৪০, ৪০x৬৫ = ২৬০০ কেজি। আনুমানিক ২৬০০ কেজি দারা পদদলিত হয়েছেন মাযলুম ইমাম হুসাইন (আ.)। তার জন্য চোখের পানি কি ফেলা যাবে না, যাবে না কান্না করা ? এরাই এজিদের উত্তরসূরী। ইমাম যায়নুল আবেদ্বীন (আ.) বলেছেন : আমার বাবার পাঁজরের হাড় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। আমি যখন আমার বাবাকে দাফন করার জন্য তার জানাযা হাতে তুলেছিলাম দেখেছি উনার হাড় গুলো টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। আমি আমার বাবাকে টুকরো টুকরো অবস্থায় দাফন করেছি।
ইয়াজিদের অনুসারী, অত্যাচারী ও অত্যাচারীদের উত্তরসূরি ব্যতিরেকে সবাই এই অসীম আত্মত্যাগকে স্বরণ করে। এই আত্মত্যাগকে স্বরণ করলেই চোখ অশ্রুজলে নিমজ্জিত হয়ে যায়। যদি আজ ইসলাম জীবিত রয়েছে সেটা একমাত্র ইমাম হুসাইন (আ.) এর এই ত্যাগের বিনিময়।
হে আল্লাহ ! আপনি তাদের প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করুন যারা মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতগন (আ.)’এর প্রতি প্রথম জুলুম করেছে এবং সর্বশেষ জালিম যে, প্রথম জালিমকে তার জুলুমের ক্ষেত্রে অনুসরণ করেছে। হে আল্লাহ যে লোকেরা ইমাম হুসাইন (আ.) এর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল, তাদের উপর লানত বর্ষণ করুন। আর তাদের অনুসারী অনুগামী ও তাদের আনুগত্য স্বীকারকারীদের প্রত্যেকের উপর লানত বর্ষণ করুন।
হে আবা আবদিল্লাহ! আপনার প্রতি ও আপনার পবিত্র সত্তার প্রতি সালাম, যে সত্তা সমাধিত হয়েছে। আমার পক্ষ থেকে আল্লাহর সালাম অনন্তকাল ব্যাপী, যতদিন এই দিবা-নিশি অবিচল আছে। আল্লাহ যেন এ যিয়ারতকেই আমার জীবনের শেষ যিয়ারতে পরিণত করে না দেন। ইমাম হুসাইন (আ.)’র সন্তানগণ ও ইমাম হুসাইন (আ.)’র সাথীদের প্রতি সালাম।
শেষে ইরানের বিশিষ্ট কবি ফুয়াদ কেরমানীর ভাষায় বলতে চাই, শত্রুরা তোমাকে মেরেছে,কিন্তু নেভে নি তো নূর তোমার হ্যাঁ,ওই নূর তো নেভার নয়, কেননা সে নূর যে খোদার । গরীবে নেওয়াজ হযরত খাজা মাইনউদ্দিন চিশতী (রহ.)'র সাথে উচ্চারন করতে চাই, হুসাইন -ই শাহানশাহ, হুসাইন -ই বাদশাহ দ্বীন (ধর্ম) হুসাইন, দ্বীনের(ধর্মের) আশ্রয়(স্থল) হুসাইন। শির দিয়েছেন, দেননি এজিদের হাতে হাত, লা ইলাহা কালেমার বুনিয়াদ হুসাইন ।।
[ লেখক : মৌলভী মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা ভুইয়া শিবপুরী, কলাম লেখক, রাজনীতিক কর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক]

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন