সত্যের পক্ষে, পক্ষের ঊর্ধ্বে

gbn

সবার ওপরে দেশ।   ভালোবাসি যেন সত্যের বাংলাদেশকে।

রাজু আহমেদ,  প্রাবন্ধিক।  

আমাদের নয়, তাদের লোক—এই অপবাদেই অজস্র প্রতিভা ধ্বংস হয়ে যায়। দলের লোক, মতের লোক খুঁজতে গিয়ে আমরা এমনকি বাংলাদেশপন্থী লোকদেরও প্রতিপক্ষ ভেবে ফেলি। যখন দেশের চেয়ে দল বড় হয়, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড় হয় তখন আর সত্য বা মহাসত্যকে ধারণ করার মানসিক উদারতা থাকে না। ভদ্রতার মুখোশ খুলে স্বার্থান্বেষী বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে মানুষে মানুষে তৈরি করি সেপারেশন— যাতে জুলুম আর শোষণ সহজ হয়। মনের অন্দরে লুকিয়ে রাখা স্বৈরতান্ত্রিকতার খায়েশ তখন মুখোশ খুলে বাস্তবতা নির্দেশ করে।

 

অনেকের ঐক্যের কথা কেবল সামাজিকতার মুখোশ; অথচ কার্যক্রম প্রকাশ করে বর্বরোচিত বিভাজন। যার চিন্তা আমার সঙ্গে মেলে না, সে সত্যবাদী হলেও তার কথা শোনা হয় না। বিরোধিতা করতেই হবে— এই মানসিকতা রাজনীতির নৈতিকতা ধ্বংস করে। শত্রুপক্ষের মধ্যে ভালো কিছু থাকতে পারে— এ কথা বলা যেন মহাপাপ। বিপক্ষ দলকে বিশ্বাস করলে দলীয় নাগরিকত্বে ছেদ পড়ে! 

 

পরিবার, প্রতিষ্ঠান, সমাজ, রাষ্ট্র—সবখানেই চলছে পক্ষ-বিপক্ষের এক বিষাক্ত খেলা। সত্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কর্তব্য ভুলুণ্ঠিত হয়। যোগ্য কেউ বিপক্ষ দলে থাকলে তার চরিত্রহননেই আমরা ব্যস্ত হই। যারা আমার অন্যায় আব্দার রাখে না, তার ন্যায়বোধকেও প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলি।

 

স্বার্থই হয়ে ওঠে ধর্ম—যে কারণে সমাজে পক্ষ বাড়ে, রাষ্ট্রে বাড়ে দল। যে ইসলামকে আল্লাহ একখানা কিতাবে এক করেছেন, সেই ইসলামেই অসংখ্য ফিরকা। দরগাহ বাড়ে, খানকাহ বাড়ে—আর বাড়ে মুর্শিদ-মুরিদের গালিগালাজ। প্রতিষ্ঠানের দলাদলিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেবাগ্রহীতা; গলাবাজিতে হারায় শ্রদ্ধা— তবু বর্বরতা থামে না।

 

বিরোধিতাও সুন্দর—যদি তা বৃহত্তর কল্যাণের পথ দেখায়। কিন্তু আমাদের এখানে বিরোধ মানে কাদা ছোড়াছুড়ি। হিংস্রতা ও পশুত্ব প্রকাশিত হয় অহরহ। প্রজন্ম কিছু শেখে না; শিখে কেবল প্রতিহিংসা। রাষ্ট্রীয় চেয়ারে বসার বিবেচনায় 'যোগ্যতা' নয়, প্রাধান্য পায় দলীয় আনুগত্য। নিজের দলের লোক না হলে তাকে সরাতে চলে ষড়যন্ত্র। এভাবে কি দেশ এগোয়?

 

উন্নত বিশ্বে এগুলো নেই বলেই তারা উন্নত। তারা দেখে যোগ্যতা; দলান্ধতা নয়। আমাদের বক্তৃতায় নৈতিকতা, লেখনীতে সাধুতা—কিন্তু কাজে সততা অনুপস্থিত। সুযোগ পেলে অন্যায়ভাবে অর্জনেও বাধে না দ্বিধা। দু’টাকার লোভ সামলাতে না পারা জাতি কোটি টাকার চুক্তিতে দেশের স্বার্থ বিক্রি করে।

 

পক্ষের জনসমর্থকদের কাছ থেকে অন্ধ আনুগত্য প্রত্যাশা করি। প্রশ্ন করলে তাকে শত্রু ভাবি। অথচ প্রশ্নহীন জাতি কখনো উন্নত হয় না। সত্যের মুখোমুখি হতে আমাদের জাতীয়ভাবে ভয়। জাতীয়তাবাদী মানসিকতার আরও বিকাশ দরকার। 

 

প্রতিষ্ঠান ও দেশ বাঁচাতে দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে যোগ্যতাকে মানদণ্ড করতে হবে। দায়িত্ব যাদের হাতে, তাদের কথা আর কাজের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। দেশের স্বার্থ সবচেয়ে ভালো যিনি বোঝেন, সবার কল্যাণ যিনি করতে পারেন—তিনি যেন এগিয়ে যান। রাজনীতি যেন উত্তরাধিকারের সম্পত্তি না হয়। সর্বত্র যেন শাসকের চেয়ে সেবকের ভূমিকা বড় হয়।

 

সচেতন মানুষের উচিত পারস্পরিক রেষারেষিকে বারণ করা। অন্যের অধিকার হরণ করে সাময়িক লাভবান হওয়া যায়, কিন্তু মানসিক প্রশান্তি তাতে আসে না। স্মরণ রাখতে হবে—যাদের কথা শুনে চলি, যাদের পক্ষে বলি, তাদের বাইরেও থাকতে পারে সত্য ও ন্যায়পরায়ণতা। যে আমার বিপক্ষের, সে আরও বড় পণ্ডিত হতে পারে। বিতর্কে তার যুক্তিও জিততে পারে।

 

বিতর্ক যুক্তির খেলা, কিন্তু রাষ্ট্রের স্বার্থে প্রয়োজন কাজ। “আমার বিপক্ষ” বলে ভালো কোনো উদ্যোগ আটকে রাখা—রাজনীতির এই অসুস্থতা আমাদেরকে শেষ করছে। জাতীয় স্বার্থে ঐক্য চাই—ইস্পাত কঠিন ঐক্য। শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত জাতির ভেতরকার বিভেদ আত্মঘাতী। যদি রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষ নিজেদের স্বার্থ নয়, দেশের স্বার্থকে বড় ভাবে—তবেই ষড়যন্ত্র ও অন্যায় অকার্যকর হবে।

 

আমার পক্ষের কে, আর বিপক্ষে কে—তার চেয়ে জরুরি, কে দেশের জন্য কাজ করছে। কে সত্য বলছে। কে দেশের কল্যাণে নিঃস্বার্থ- তাকে সম্মান করা। দেশ যদি ধ্বংস হয়, পক্ষের মঞ্চ থাকবে না। দেশ যদি জিতে যায়, জয় হয় সবার।

 

সবার ওপরে দেশ।

ভালোবাসি যেন সত্যের বাংলাদেশকে।

 

 

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন