হুসনা খান হাসি ||
ধর্ষণ কেবল একটি শারীরিক নির্যাতন নয়, এটি একটি গভীর সামাজিক সংকট, যা ভুক্তভোগীর মানসিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি শুধু শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন না, বরং সমাজের নানা স্তরে তাকে অপমান, অবজ্ঞা ও স্টিগ্মার (কলঙ্ক) শিকার হতে হয়। এই স্টিগ্মা বা সামাজিক কলঙ্কের ফলে অনেক ভুক্তভোগী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন এবং অপরাধীরা শাস্তির বাইরে থেকে যান। এই প্রবন্ধে ধর্ষণের সামাজিক স্টিগ্মা, এর ফলাফল, বিভিন্ন দেশের পরিসংখ্যান এবং প্রতিরোধের উপায় নিয়ে আলোচনা করা হবে।
ধর্ষণের সামাজিক কলঙ্ক বা স্টিগ্মা বলতে সাধারণত কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি নেতিবাচক সামাজিক ধারণা বোঝানো হয়। ধর্ষণের ক্ষেত্রে এই স্টিগ্মার অর্থ হলো, সমাজ ভুক্তভোগীকেই দোষারোপ করা, তাকে হেয় করা, এবং তার প্রতি সহানুভূতির পরিবর্তে সন্দেহ ও অবজ্ঞা প্রদর্শন করা। সমাজে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিদের আরও সংকটাপন্ন করে তোলে। যেমন:
১- “মেয়েটি হয়তো প্ররোচনা দিয়েছিল” – অনেক সমাজে এখনো বিশ্বাস করা হয় যে মেয়েটির পোশাক, চলাফেরা বা আচরণ ধর্ষণের কারণ হতে পারে। কিন্তু গবেষণা ও পরিসংখ্যান বলছে, শিশুরা, বয়স্ক নারী, এমনকি বোরকা পরিহিত নারীরাও ধর্ষণের শিকার হন, যা প্রমাণ করে যে ধর্ষণ মূলত অপরাধীর মানসিক বিকৃতির কারণে ঘটে, ভুক্তভোগীর আচরণ এর জন্য দায়ী নয়।
২- “ধর্ষণের শিকার হওয়া মানে জীবন শেষ” – ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকে সমাজ অনেক সময় ‘কলঙ্কিত’ বা ‘অযোগ্য’ বলে মনে করে, যার ফলে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন বা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
৩- “ধর্ষিতাকে বিয়ে করলেই সমস্যার সমাধান” – অনেক দেশে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে, এখনো বিশ্বাস করা হয় যে ধর্ষণের পর ধর্ষকের সাথে ভুক্তভোগীর বিয়ে হলে এটি সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু এতে অপরাধীর শাস্তি হয় না এবং ভুক্তভোগী আজীবন নির্যাতনের শিকার হন।
ধর্ষণের বর্তমান পরিস্থিতি, পরিসংখ্যান ও গবেষণা
বিশ্বজুড়ে ধর্ষণের হার উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তবে অনেক দেশেই এর প্রকৃত সংখ্যা জানা যায় না কারণ অধিকাংশ ঘটনা রিপোর্ট করা হয় না। কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান নিচে উল্লেখ করা হলো:
-জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন (২০২৩) অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজন কোনো না কোনো সময় যৌন সহিংসতার শিকার হন।
-ভারতে, ২০২২ সালে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (NCRB) রিপোর্টে বলা হয়, প্রতিদিন গড়ে ৮৬টি ধর্ষণের মামলা নথিভুক্ত হয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি।
-বাংলাদেশে, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১,৩২১ জন নারী, যার মধ্যে ৬৬ জন ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হন।
-যুক্তরাষ্ট্রে, ন্যাশনাল সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স রিসোর্স সেন্টার (NSVRC) এর রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি ৭৩ সেকেন্ডে একজন আমেরিকান যৌন নিপীড়নের শিকার হন।
এই পরিসংখ্যানগুলো দেখায় যে ধর্ষণ একটি বৈশ্বিক সমস্যা এবং এর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও অবনতি হবে।
ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির উপর স্টিগ্মার প্রভাব
ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির উপর সামাজিক স্টিগ্মার বহুমুখী প্রভাব পড়ে, যা তাকে দীর্ঘমেয়াদে মানসিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এর মধ্যে কয়েকটি প্রধান প্রভাব হলো:
১- মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি – ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির মধ্যে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD), বিষণ্নতা, আতঙ্কজনিত ব্যাধি এবং আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়।
২- পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের অবনতি – অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর পরিবারও তাকে দোষারোপ করে, ফলে তিনি একাকীত্বের শিকার হন।
৩- শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে বাধা – স্টিগ্মার কারণে অনেক ধর্ষণের শিকার নারী স্কুল বা কর্মক্ষেত্র থেকে বাদ পড়েন, যা তাদের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তোলে।
৪- ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়া – সামাজিক লজ্জা ও হুমকির কারণে অনেক ভুক্তভোগী মামলা করতে ভয় পান, যার ফলে অপরাধীরা শাস্তি এড়াতে পারে।
স্টিগ্মা দূর করতে করণীয়
ধর্ষণের সামাজিক স্টিগ্মা দূর করতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। নিচে কয়েকটি কার্যকর পদক্ষেপ তুলে ধরা হলো:
১- সচেতনতা বৃদ্ধি – ধর্ষণ সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে স্কুল-কলেজে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা দরকার। গণমাধ্যমকেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে।
২- আইনি সহায়তা নিশ্চিত করা – ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির নিরাপত্তা ও আইনি সহায়তা নিশ্চিত করতে সরকারকে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩- ভুক্তভোগীদের মানসিক ও সামাজিক সহায়তা প্রদান – কাউন্সেলিং সেবা এবং পুনর্বাসন কার্যক্রম চালু করা উচিত, যাতে ভুক্তভোগীরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন।
৪- ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা – আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে আরও কঠোর হতে হবে, যাতে অপরাধীরা শাস্তির ভয় পায়।৫- ভিকটিম ব্লেমিং বন্ধ করা – পরিবার ও সমাজকে বোঝাতে হবে যে ধর্ষণের দায় ভুক্তভোগীর নয়, বরং অপরাধীর।
সর্বশেষে, ধর্ষণ একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি, যা কেবল ভুক্তভোগীর জীবন ধ্বংস করে না, বরং পুরো সমাজের জন্যই অস্থিরতা সৃষ্টি করে। ধর্ষণের পর সামাজিক স্টিগ্মা ভুক্তভোগীদের জন্য আরেকটি শাস্তির মতো কাজ করে। তাই এই স্টিগ্মা দূর করা, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। পরিবার, সমাজ, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও সরকার একসঙ্গে কাজ করলে ধর্ষণের হার কমিয়ে আনা সম্ভব এবং ভুক্তভোগীদের জন্য একটি নিরাপদ ও সম্মানজনক জীবন নিশ্চিত করা যেতে পারে।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন