প্লট ও ফ্ল্যাট কেলেঙ্কারি এবং রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র প্রকল্প ঘিরে দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরুর পর এবার ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি এবং যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির পার্লামেন্ট সদস্য (এমপি) ও সাবেক মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে আয়কর নথিতে অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারপর থেকে তার পরিবারের সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে।
৫ আগস্টের প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার সঙ্গে তার বোন শেখ রেহানাও ভারতে চলে যান। পরে তিনি যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। তার মেয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এমপি ও সাবেক মন্ত্রী টিউলিপও থাকেন লন্ডনে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠলে সমালোচনার মুখে গত জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্য সরকারের সিটি মিনিস্টারের (ইকোনমিক সেক্রেটারি টু দ্য ট্রেজারি অ্যান্ড সিটি মিনিস্টার) পদ থেকে পদত্যাগ করেন টিউলিপ সিদ্দিক। তিনি গত বছর দেশটির সাধারণ নির্বাচনে লন্ডনের হ্যাম্পস্টিড অ্যান্ড হাইগেট আসন থেকে টানা চতুর্থবারের মতো পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর জুলাইয়ে তাকে লেবার পার্টি সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনীতিবিষয়ক মিনিস্টার করা হয়েছিল।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে টিউলিপের নিট লাভ ছিল তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা। টিউলিপ বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনা করেছেন এবং তা থেকে নিয়মিত লাভও পেয়েছেন।- আয়কর নথির তথ্য
সূত্র জানায়, টিউলিপের আয়কর নথি বিশ্লেষণ করে অনিয়ম খুজেঁ পেয়েছে দুদক। সম্প্রতি তার ১৩ বছরের আয়কর নথি জব্দ করার পর তা খুটিয়ে বিশ্লেষণ করেছে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থাটি। এ সংক্রান্ত নথি জাগো নিউজের সংগ্রহে রয়েছে।
টিউলিপ ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন। এরপর থেকে তিনি আর আয়কর রিটার্ন জমা দেননি। ২০০৬-০৭ করবর্ষ থেকে ২০১৮-১৯ করবর্ষ পর্যন্ত দাখিল করা রিটার্ন এবং সংশ্লিষ্ট নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মোট ৮৭টি পৃষ্ঠার এসব নথির মধ্যে ২০০৬-২০১৫ করবর্ষ পর্যন্ত প্রতিটি আয়কর রিটার্নে ‘অ্যাডভান্স টুওয়ার্ডস ডেভেলপার্স’ শিরোনামে পাঁচ লাখ টাকা ব্যয়ের তথ্য রয়েছে।
২০০২ সালের ৩০ অক্টোবরের সাফকবলা দলিল নম্বর–১৪০৭১ অনুযায়ী, টিউলিপ গুলশান সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রি করা ফ্ল্যাটটির মালিক এবং ভোগদখলে ছিলেন। কিন্তু তিনি সেই ফ্ল্যাটটি তার আয়কর নথিতে মালিকানা হিসেবে উপস্থাপন না করে মিথ্যাভাবে ডেভেলপার কোম্পানিকে অগ্রিম টাকা দেওয়ার তথ্য দিয়েছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে আসে।
আয়কর নথিতে টিউলিপ দাবি করেছেন, ২০১৫-১৬ করবর্ষে ঢাকার গুলশানের ফ্ল্যাটটি (বি/২০১, প্লট নং এনই(এ)১১বি) তার ছোট বোন আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীকে হেবা (মুসলিম আইনে কাউকে সম্পত্তি দান করা) করেছেন। আয়কর রিটার্নে দাখিলকৃত হেবা দলিল (রেজি: নং–০১, তারিখ: ২১/০৬/২০১৫) একটি নোটারি পাবলিক কর্তৃক প্রত্যয়িত দলিলও সংযুক্ত করেছেন।
‘টিউলিপের নামে তলবি নোটিশ পাঠানো হচ্ছে। রাজউকের প্লট, গুলশানে প্লট বরাদ্দে অনিয়মসহ আরও কয়েকটি অভিযোগ রয়েছে। হঠাৎই তার স্বর্ণের পরিমাণ ১০ ভরি থেকে বেড়ে ৩০ ভরি হয়ে গেছে, অথচ এর দামে কোনো পরিবর্তন হয়নি’
তবে ২০০৪ সালের রেজিস্ট্রেশন আইন অনুযায়ী, কোনো স্থাবর সম্পত্তি নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে হস্তান্তরযোগ্য নয়। এ হস্তান্তর অবশ্যই সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে রেজিস্ট্রি হতে হয়। আবার ওই হেবা দলিলের নোটারি পাবলিক হিসেবে প্রত্যয়নকারী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট গাজী সিরাজুল ইসলামের নাম প্রদর্শিত হয়েছে।
অ্যাডভোকেট গাজী সিরাজুল ইসলাম দুদককে জানিয়েছেন, দলিলে যে স্বাক্ষর রয়েছে সেটি তার নয়। তিনি ২০১২ সালে নোটারি পাবলিক হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছেন এবং কোনো বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নোটারি কাজ করেন না। সুতরাং, ফ্ল্যাটটি অবৈধ উপায়ে অর্জিত বলেই টিউলিপ তা আয়কর নথিতে গোপন রেখেছেন এবং অগ্রিম প্রদান মিথ্যা দেখিয়ে ফ্ল্যাটটি বোনের নামে হস্তান্তরের অপচেষ্টা করেছেন বলে তথ্য পেয়েছে দুদক।
সংস্থাটির নথি বিশ্লেষণ করে আরও দেখা গেছে, সহকারী কমিশনার (ভূমি), গুলশান-এর স্মারক নং–ভূসক/গুল/২৯৮, তারিখ: ২৪/০৫/২০২৫ অনুযায়ী, টিউলিপ সিদ্দিকের নামে গুলশান অফিসে কোনো নামজারি হোল্ডিং বা জমি খুঁজে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ, টিউলিপ সাফকবলা দলিল নং–১৪০৭১ অনুসারে মালিক হলেও ফ্ল্যাটটি আজও নামজারি করেননি।
গুলশানের একটি প্লট অবৈধভাবে হস্তান্তরের ব্যবস্থা করিয়ে ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের কাছ থেকে ঘুষ হিসেবে একটি ফ্ল্যাট নেওয়ার অভিযোগে গত ১৫ এপ্রিল টিউলিপের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। তবে টিউলিপসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দুদকের করা এ মামলার কার্যক্রম একজনের ক্ষেত্রে স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। দুদক ও আবেদনকারীর আইনজীবী জানান, এ সংক্রান্ত আবেদনের শুনানি নিয়ে ৮ জুলাই হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ রুল ও স্থগিতাদেশ দেন।
এ মামলায় টিউলিপ ছাড়া অন্য দুই বিবাদী হলেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সাবেক সহকারী আইন উপদেষ্টা শাহ মো. খসরুজ্জামান এবং সাবেক সহকারী আইন উপদেষ্টা-১ সরদার মোশারফ হোসেন। দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে সংস্থাটির সহকারী পরিচালক মনিরুল ইসলাম বাদী হয়ে গত ১৫ এপ্রিল মামলাটি করেন।
পরে ওই মামলার কার্যক্রম বাতিল চেয়ে শাহ খসরুজ্জামান হাইকোর্টে আবেদন করেন। ওই আবেদনের শুনানি নিয়ে গত ৮ জুলাই রুল দিয়ে হাইকোর্ট শাহ খসরুজ্জামানের ক্ষেত্রে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেছেন। তবে হাইকোর্টের এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, দুদকের আইন বিভাগ বিষয়টি দেখছেন। আয়কর নথিতে ভুল তথ্য ও ফ্ল্যাট জালিয়াতির বিষয়টি তদন্তাধীন থাকায় এ নিয়ে সংস্থাটির অন্য কেউ মন্তব্য করতে চাননি।
অনেক জায়গা থেকে আমরা দালিলিক প্রমাণাদি সংগ্রহ করতে পারিনি। আমাদের কাছে সেগুলো এসে পৌঁছায়নি। সেকারণে কিছুটা সময় লাগছে। এগুলো পাওয়া সাপেক্ষে অনুসন্ধান দল তাদের প্রতিবেদন দাখিল করবে।- দুদক মহাপরিচালক
গুলশানের ফ্ল্যাট জালিয়াতির মামলার এজাহারে বলা হয়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড থেকে ৭১ নম্বর রোডের ১১/এ, ১১/বি ফ্ল্যাটটি (পুরনো ঠিকানা–ফ্ল্যাট নম্বর বি/২০১, বাড়ি নম্বর ৫এ ও ৫বি (পুরোনো), বর্তমানে- ১১৩, ১১বি (নতুন), রোড নং ৭১) কোনো টাকা পরিশোধ না করেই নিয়েছেন টিউলিপ।
দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন বলেন, মামলায় টিউলিপ সিদ্দিক, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সাবেক সহকারী আইন উপদেষ্টা শাহ খসরুজ্জামান এবং সাবেক সহকারী আইন উপদেষ্টা-১ সরদার মোশারফ হোসেনকে আসামি করা হয়। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোনো টাকা পরিশোধ না করেই অবৈধভাবে ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের ওই ফ্ল্যাট দখল ও পরে রেজিস্ট্রি করে নেন।
এছাড়া আয়কর নথিতে উল্লেখ করা হয়, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে দাদার কাছ থেকে উপহার হিসেবে টিউলিপের পাওয়া ১০ তোলা (১ তোলা সমান ১ ভরি হিসাবে ১০ ভরি) স্বর্ণের দাম দেখানো হয় এক লাখ টাকা। ২০১২-১৩ সময়ে সেই স্বর্ণের পরিমাণ বেড়ে হয় ৩০ তোলা, তবে দাম দেখানো হয় একই। ২০১৩-১৪ করবর্ষে মৎস্য খামার থেকে ৯ লাখ টাকা আয় নিজের আয়কর নথিতে দেখান টিউলিপ। আয়কর নথি অনুযায়ী, টিউলিপ ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ব্যবসা থেকে এক লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা নিট লাভ দেখিয়েছেন।
এরপর ধারাবাহিকভাবে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে এক লাখ ৯৫ হাজার ৪০০ টাকা, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দুই লাখ ১৫ হাজার, ২০০৯-১০ অর্থবছরে দুই লাখ ২০ হাজার, ২০১০-১১ অর্থবছরে দুই লাখ ১৬ হাজার, ২০১১-১২ অর্থবছরে দুই লাখ ৪০ হাজার, ২০১২-১৩ অর্থবছরে দুই লাখ ৬৫ হাজার এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তিন লাখ ৮৫ হাজার টাকা নিট লাভ দেখানো হয়।
সর্বশেষ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তার নিট লাভ ছিল তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা। আয়কর নথির তথ্য অনুযায়ী, টিউলিপ বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনা করেছেন এবং তা থেকে নিয়মিত লাভও পেয়েছেন।
আয়কর নথিতে স্বর্ণের বিষয়টি দুদক চেয়ারম্যানও জানিয়েছিলেন। গত ১৬ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, টিউলিপের নামে তলবি নোটিশ পাঠানো হচ্ছে। রাজউকের প্লট, গুলশানে প্লট বরাদ্দে অনিয়মসহ আরও কয়েকটি অভিযোগ রয়েছে। তার আয়কর রিটার্ন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, হঠাৎই তার স্বর্ণের পরিমাণ ১০ ভরি থেকে বেড়ে ৩০ ভরি হয়ে গেছে, অথচ এর দামে কোনো পরিবর্তন হয়নি।
এর আগে গত ১৩ এপ্রিল ক্ষমতার অপব্যবহার করে পূর্বাচলে ৩০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক এবং আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীসহ ৫৩ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আদালত।
বিভিন্ন অভিযোগে শেখ হাসিনা পরিবারের সদস্যের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেছে দুদক। তবে পরিবারটির সদস্যদের বিদেশে থাকা সম্পদের দালিলিক তথ্যপ্রমাণ যথাসময়ে না পাওয়ায় অনুসন্ধান ও তদন্ত বিলম্বিত হওয়ার কথা জানিয়েছেন দুদক মহাপরিচালক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আক্তার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনুসন্ধানাধীন বিষয়গুলো নিয়ে কমিশন সচেষ্ট রয়েছে। যেসব ক্ষেত্রে দেশের বাইরে থেকে অনেক তথ্যাদি সংগ্রহ করতে হয়; সেক্ষেত্রে অনেক জায়গায় এমএলআর (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট) পাঠিয়েছি।’
দুদক মহাপরিচালক বলেন, ‘অনেক জায়গা থেকে আমরা দালিলিক প্রমাণাদি সংগ্রহ করতে পারিনি। আমাদের কাছে সেগুলো এসে পৌঁছায়নি। সেকারণে কিছুটা সময় লাগছে। এগুলো পাওয়া সাপেক্ষে অনুসন্ধান দল তাদের প্রতিবেদন দাখিল করবে।’
জিবি নিউজ24ডেস্ক//

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন